জাতীয় ফল কাঠাল সম্পর্কে জানুন

 

কাঠাঁল ও কাঠাঁল গাছের সাধারণ পরিচয়ঃ

কাঁঠাল (Jack fruit) বাংলাদেশের জনপ্রিয় ও জাতীয় ফল। উদ্ভিদবিজ্ঞানের পরিভাষায় সরোসিস (sorosis) নামের এ অতিবৃহৎ ফল বস্ত্তত স্ত্রীপুষ্পধর গোটা ক্যাটকিন মঞ্জরির পরিবর্তিত রূপ, তাতে থাকে ১০০-৫০০ বড় বড় তৈলাক্ত বীজ। শাঁসালো যে অংশ খাওয়া যায় তা আসলে পুষ্পপুট। কাঁঠালের নিকট জ্ঞাতি, ডেউয়া (A. lakoocha) ও ব্রেডফ্রুট (A. altilis) প্রজাতি দুটির মধ্যে ডেউয়া বাংলাদেশে জন্মে।

কাঁঠালের আদি নিবাস ভারতের পশ্চিমঘাট পর্বতমালা, যেখানে আজও বুনো কাঁঠাল ফলে। কাঁঠাল আসাম ও বার্মার চিরসবুজ বনেও ফলে। উষ্ণমন্ডল ও উপ-উষ্ণমন্ডলের বিস্তৃত নিম্নভূমিতে এখন কাঁঠাল ছড়িয়ে পড়েছে। সারা বাংলাদেশে থাকলেও নওগাঁ, দিনাজপুর, সাভার, মধুপুর ও সিলেট কাঁঠাল প্রধান এলাকা। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী এদেশে বছরে ৭ লক্ষ ২০ হাজার মে টন কাঁঠাল ফলে।
কাঁঠালগাছ চিরসবুজ এক বৃক্ষ, ৯-২৫ মিটার পর্যন্ত উঁচু, দুধকষভরা। কান্ড খাড়া, গোড়ার কাছে সাধারণত শাখাবিভক্ত। কাঁঠাল গাছের জন্য আর্দ্র ও উষ্ণ জলবায়ু, মাটিতে পর্যাপ্ত আর্দ্রতা, গভীর দোঅাঁশ মাটি, উত্তম পানি নির্গম ব্যবস্থা আবশ্যক। কাঁঠাল গাছে ফুল আসে ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসে এবং ফল পাকে মে-জুলাই মাসে। ফলে আছে ভিটামিন ‘এ’ ও ‘সি’, আর বীজে শর্করা, প্রোটিন ও চর্বি। রসালো শাঁস তাজা খাওয়া হয় এবং সিরাপ হিসেবেও সংরক্ষণ করা যায়। ভাজা ও সিদ্ধ বীজ এবং বীজের তরকারি যথেষ্ট জনপ্রিয়। এ ছাড়া কাঁচাফল উত্তম সবজি, এ ফল দিয়ে আচারও বানানো যায়। গাছের পাতা ও কাঁঠালের উচ্ছিষ্ট পশুখাদ্য। কাঠ আসবাব ও বাদ্যযন্ত্রে ব্যবহার্য। গোটা ফল বেশি দিন সংরক্ষণ করা যায় না বলে কাঁঠাল বিদেশে রপ্তানি করার উপযোগী নয়। তবে আজকাল অনেকে বিমানে করে এ ফল বিদেশেও নিয়ে যাচ্ছে।  

কাঠালের ধরণঃ 

কাঁঠালের কোনো অনুমোদিত জাত নেই। তবে তিন ধরণের কাঁঠাল চাষ হয়-খাজা, আদারসা ও গালা।

কাঁঠাল কেন জাতীয় ফলঃ

কাঁঠাল কেন জাতীয় ফল বলা হয়  এমন প্রশ্ন অনেকের।

কাঁঠালের পুষ্টিগুণঃ

কাঁঠালে সামান্য পরিমাণ প্রোটিন রয়েছে। প্রতি ১০০ গ্রাম পাকা কাঁঠালে ১.৮ গ্রাম, কাঁচা কাঁঠালে ২০৬ গ্রাম ও কাঁঠালের বীজে ৬.৬ গ্রাম প্রোটিন পাওয়া যায়। এই প্রোটিন দেহের গঠনে সাহায্য করে। কাঁঠালে রয়েছে শ্বেতসার।পাকা কাঁঠালে ০.১ গ্রাম, কাঁচা কাঁঠালে ০.৩ ও কাঁঠালের বীজে ০.৪ গ্রাম শ্বেতসার পাওয়া যায়।

কাঁঠালে রয়েছে ভিটামিন এ। ভিটামিন এ দৃষ্টিশক্তি বাড়াতে সাহায্য করে। কাঁঠালের অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট উপাদান চোখের রেটিনার ক্ষতি প্রতিরোধ করে।
কাঁঠালে রয়েছে ভিটামিন সি। পাকা কাঁঠালে ২১ মি. গ্রাম, কাঁচা কাঁঠালে ১৪ মি. গ্রাম এবং কাঁঠালের বীজে ১১ মি. গ্রাম ভিটামিন ‘সি’ পাওয়া যায়।

কাঁঠালের গুনাগুন

পুষ্টি মূল্য: আমিষ ও ভিটামিন এ সমৃদ্ধ।
ভেষজ গুণ: কাঁঠালের শাঁস ও বীজকে চীন দেশে বলবর্ধক হিসেবে ব্যবহার করা হয়। কাঁঠালের শিকড়ের রস জ্বর ও পাতলা পায়খানা নিরাময়ে ব্যবহার করা হয়।

কাঠাঁলের ঔষধি গুণ ঃ 

আয়ুর্বেদীয় মতে মানব দেহের কোন অংশ ফুলে গেলে কাঠালের আঠা লাগালে উপকার হয়। * ফোঁড়ার চারপাশে কাঁঠালের আঠা লাগালে ফোঁড়া পেকে যায়। * নেশাকারীদের বা ফুড পয়েজনিং হলে বা অন্যকোন কারণে বমি করানো প্রয়োজন হলে কচি কাঁঠালের পাতার রস খাওয়ালে অতি সহজে বমি হয়। * পেটের কোন সমস্যা হলে বা পাতলা পায়খানা হলে কাঁঠালের বিঁচি পুড়িয়ে বা তরকারি করে খেলে উপকার পাবেন। * মানব দেহের চামড়ার উপর কোন রোগ দেখে দিলে কাঁঠাল গাছের কঁচি পাতার রস লাগালে উপকার পাবেন। * রক্ত আমাশয় হলে কাঁঠাল গাছের বাকলে রস ও চুনের পানি মিশিয়ে খেলে উপকার পাবেন। * গাছের কঁচি পাতার রস ও মূলের রস হাপানি রোগের জন্য বেশ উপকারী। * যারা রোগারোগা থাকেন বা শরীরে শক্তির পরিমাণ কম তারা দুধের সাথে কাঁঠাল মিশিয়ে খান বেশ উপকার পাবেন।

কাঁচা কাঁঠাল খাওয়ার উপকারিতা-

১. উচ্চমানের অ্যান্টিঅক্সিড্যান্টসমৃদ্ধ ফল কাঁঠাল। এতে থাকা ভিটামিন সি শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। এ ছাড়া ক্যান্সার ও টিউমারের বিরুদ্ধেও প্রতিরোধ গড়ে ওঠে।
২. এতে থাকা সোডিয়াম ও পটাশিয়াম শরীরের ইলেকট্রোলাইট ব্যালেন্সকে ঠিক রাখে, যা উচ্চরক্তচাপ ও হার্টও ভালো রাখে।
৩. কাঁঠাল ফাইবারসমৃদ্ধ ফল হওয়ায় হজমশক্তি বাড়ায় এবং পেট পরিষ্কার রাখে।
৪. কাঁঠালে রয়েছে প্রচুর পরিমাণ ভিটামিন এ এবং বিটা ক্যারোটিন, যা চোখ ভালো রাখে।
৫. কাঁঠালে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট থাকায় ত্বকের উজ্জ্বলতা বাড়ে ও বলিরেখাও কমে।
৬. কাঁঠালে রয়েছে ভিটামিন বি৬ এবং প্রচুর পরিমাণ ক্যালোরি। আর নেই কোলেস্টেরল নেই।
৭. কাঁঠালে আয়রন থাকে, যা রক্তে লোহিতকণিকার পরিমাণ বাড়ায়। রক্তাল্পতায় রোগীদের জন্য কাঁঠাল খুবই উপকারী।
৭. কাঁঠাল পাইলস ও কোলন ক্যান্সারের ঝুঁকি কমায়।


কাঁঠালের উপকারিতা ও অপকারিতা

উপকারিতা ঃ কাঁঠালে প্রচুর পরিমানে ভিটামিন এ পাওয়া যায়। যা আমাদের নানা রোগের হাত থেকে বাঁচিয়ে রাখে। রাতকানা অর্থাৎ যারা রাতের বেলা চোখে কম দেখে তা প্রতিরোধ করে বিশেষ করে আমাদের দেশে শিশু এ রোগে ভোগে বেশি। আমাদের দেশে প্রতি বছর ভিটামিন এ-এর অভাবে প্রায় ৩৫-৪০ হাজার শিশু রাতকানা রোগে আক্রান্ত হয়। আমরা একটি সচেতন হয়ে যদি মৌসুমী ফল বা কাঁঠাল জাতীয় খাবার অথবা ভিটামিন এ সমৃদ্ধ ফল শিশুদের খাওয়ানো হয় তাহলে এ রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।
কাঁঠালে প্রচুর পটাশিয়াম আছে। পটাসিয়াম মানব দেহের উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করে রাখে। কাঁঠালে যে আঁশ থাকে তা আমাদের হজম কাজকে খুব সহজ করে। ফলে আমাদের পায়খানা পরিষ্কার হয় অতি সহজে। কাঁঠালে শক্তিশালী অন্টিঅক্সিডেন্ট থাকে যা দেহকে ক্ষতিকর ফ্রি র‌্যাডিকেলস থেকে রক্ষা করে এবং দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে।
কাঁঠালে চর্বির পরিমাণ খুবই কম। তাই বেশী কাঁঠাল খেলে দেহের ওজন বৃদ্ধি পায় না। কাঁঠালের ক্যালসিয়াম ও ম্যাগনেসিয়াম দেহের হাঁড় ও দাঁতের গঠন সুরক্ষা করে। কাঁঠালের নানা উপাদান আমাদের মস্তিষ্ককে সুরক্ষা রাখে এবং স্নায়ুর দুর্বলতা কমায়। এ ফলে থাকা ম্যাগনেসিয়াম শরীরে নানা ধরনের রোগ প্রতিরোধ করে এবং রক্তে শর্করা বা চিনির পরিমাণ ঠিক রাখে কাঠালের ফাইটোনিউট্রিয়েন্টস উপাদান আলসার উচ্চ রক্তচাপ এবং শরীরের চামড়া কুছকিয়ে যাওয়া বা বার্ধক্য প্রতিরোধে বিরাট ভূমিকা পালন করে।
কাঁঠালে ভিটামিন বি-৬ থাকে যা হৃদ রোগের ঝুকি কমায়। পুষ্টি বিজ্ঞানীদের মতে প্রতিদিন নিয়মিত ২০০ গ্রাম কাঁঠাল খেলে গর্ভবতী মহিলা ও গর্ভের সন্তানের সব ধরনের ভিটামিন ও খনিজ উপাদানের অভাব পূরণ হয়। যেসব মায়েরা শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ান তারা নিয়মিত কাঁঠাল খান বুকে প্রচুর দুধ উৎপন্ন হবে ও শিশু বলবান হবে। কাঁঠালে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি পাওয়া যায় যা আমাদের ঘন ঘন সর্দি, কাশি বা ঠান্ডা লাগা, দাঁতে সমস্যা কমাতে বিরাট ভূমিকা পালন করে এবং মুখের রুচি বাড়ায়। কাঁঠালের অন্টিঅক্সিডেন্টের মধ্যে রয়েছে বিটা ক্যারটিন, লুটেইন যা প্রোস্টেট, স্তন, পাকস্থলি ফুসফুসের ক্যান্সার প্রতিরোধ করে। কাঁঠালের জিংক শরীরের ইনসুলিন হরমোনের সরবরাহ নিশ্চিত করে এবং ম্যাগনেসিয়াম ও সোডিয়াম দেহের লবণ ও ক্ষারের ভারসাম্য রক্ষা করে।

কাঁঠালের বিচির পুষ্টিগুণ ও উপকারীতা

কাঁঠালের বিচির পুষ্টিগুণ বা কাঁঠালের বীজের উপকারিতা জানলে আর কোনওদিন সেটিকে ফেলে দেওয়ার কথা  কেউ মাথাতে আনবে না। 
১.বলিরেখা দূর করে
ত্বকে বলিরেখা থেকে নিষ্কৃতি দিতে ম্যাজিকের মতো কাজ করে কাঁঠালের বীজ। একটি বীজ কোল্ড ক্রিমের সঙ্গে পিষে পেস্ট তৈরি করুন। তারপর সেটি নিয়মিত ত্বকে লাগান। বলিরেখা পালাবে। কাঁঠালের বীজ আপনার ত্বককে করে তুলবে সজীব ও তরতাজা। দু-একটি বীজ সামান্য দুধ ও মধুতে কিছুক্ষণ ভিজিয়ে রেখে, সেটা দিয়ে একটি পেস্ট তৈরি করুন। সেই পেস্ট সারা মুখে লাগিয়ে শুকোতে দিন। তারপর উষ্ণ গরম জলে মুখটা ধুয়ে ফেলুন। দেখবেন, ত্বকের ঔজ্জ্ল্য বেড়ে দ্বিগুণ হয়ে যাবে।
২.মানসিক চাপ কমায়, ত্বকের রোগ সারায়
কাঁঠালের বীজ প্রোটিন ও মাইক্রোনিউট্রিয়েন্টসে ঠাসা। সেজন্যই এটি মানসিক চাপ কমাতে বিশেষ কার্যকরী। এটি ত্বকের নানা রোগও সারায়। ত্বকে ময়েশ্চারের মাত্রা বেশি রাখতে ও স্বাস্থ্যকর চুল পেতে নিয়মিত কাঁঠালের বীজ খাওয়া ভালো।
৩.রক্তস্বল্পতার শত্রু
রোজ মেনুতে কাঁঠালের বীজ রাখলে আপনার শরীরের আয়রনের মাত্রা বাড়বে। এই বীজে প্রচুর পরিমাণে আয়রন থাকে। কাঁঠালের বীজ হিমোগ্লোবিনের একটি উপাদান। ফলে এটি খেলে অ্যানিমিয়া বা রক্তস্বল্পতা দূরে হঠবে। আয়রন সুস্থ রাখবে আপনার মস্তিষ্ক ও হার্টকেও।
৪.স্বাস্থ্যকর চুল ও ভালো দৃষ্টিশক্তি
কাঁঠালের বীজে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন এ থাকে। চোখের স্বাস্থ্যের জন্য এই ভিটামিন অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। এটি রাতকানা রোগ কাটাতেও সাহায্য করে। শুধু চোখ নয়, চুলের স্বাস্থ্যও ভালো রাখে ভিটামিন এ। চুলের আগা ফেটে যাওয়া রোধ করে এই ভিটামিন।
৫.হজমশক্তি বাড়ায়
বদহজম রোধে খুবই কার্যকরী কাঁঠালের বীজ। এটি রোদে শুকিয়ে বেঁটে পাউডারের মতো করে ফেলুন। বদহজমে সহজ হোমমেড রেমেডি হতে পারে এই পাউডার। এতকিছু না করে শুধু কাঁঠালের বীজ খেলে কমবে কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা। কারণ প্রচুর ফাইবার থাকে কাঁঠালের বীজে। 

তথ্যসুত্রঃ    বাংলাপিডিয়া   কৃষি তথ্য সার্ভিস   দৈনিক যুগান্তর  দৈনিক ইনকিলাব

কাঠাঁল সম্পর্কে গুগলে খুজুনঃ 

কাঁঠাল কেন জাতীয় ফলকাঁঠালের বিচির পুষ্টিগুণ কাঁঠালের গুনাগুন

Previous Post Next Post

نموذج الاتصال