বঙ্গবন্ধুর হাতেই জন্ম শরীয়তপুর জেলার
মো: আজিজুল হক (দৈনিক নয়া দিগন্ত)

 বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাত ধরেই জন্ম হয়েছিল পদ্মাপাড়ের ঐতিহ্যবাহী জেলা শরীয়তপুরের। এ বিষয়ে কাউকে কথা বলতে দেখা যায় না। এ বিষয়ে নীরবতা শরীয়তপুরের ইতিহাসকে ম্লান করে দিচ্ছে। ঢাকা পড়ে যাচ্ছে এ জেলা গঠনের প্রকৃত ইতিহাস। অন্ধকারে থেকে যাচ্ছে আজকের প্রজন্ম। বঙ্গবন্ধুর একজন কর্মী এবং শরীয়তপুর জেলা গঠনের সাক্ষী হিসেবে ৯৩ বছর বয়সে আজ তুলে ধরছি আমাদের প্রিয় জেলা গঠনের অজানা অধ্যায়।

১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু প্রথমে তৎকালীন মাদারীপুর মহকুমার পাঁচটি থানা (বর্তমানে উপজেলা) ভেদরগঞ্জ, ডামুড্যা, গোঁসাইরহাট, নড়িয়া ও পালং নিয়ে শরীয়তপুর মহকুমার অনুমোদন দেন। তিনি শরীয়তপুরের জেলা সদর দফতরের স্থান হিসেবে ভেদরগঞ্জ থানার মহিষারের দিগাম্বরীর নামও নির্বাচন করেন। তিনি তা বাস্তবায়ন করে যেতে পারেননি। সরকারিভাবে ঘোষণা আসার আগেই ১৫ আগস্ট সপরিবারে শাহাদাতবরণ করেন। তিনি আর শরীয়তপুরকে জেলা হিসেবে দেখে যেতে পারেননি।

অবশেষে ১৯৭৭ সালের ১০ আগস্ট জিয়াউর রহমানের সময় সরকারিভাবে ঘোষিত হয় শরীয়তপুর মহকুমা এবং এরশাদের সময় ৭ মার্চ ১৯৮৩ সালে শরীয়তপুর মহকুমাকে জেলায় উন্নীত করা হয়। বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিকে মুছে ফেলার জন্য শরীয়তপুরের সদর দফতর মহিষারের দিগাম্বরীতে না করে পালংকে বেছে নেয়া হয়। পাঁচটি থানার সাথে যোগ করা হয় জাজিরাকে। এভাবেই শরীয়তপুর জেলা গঠনে বঙ্গবন্ধুর ভ‚মিকাকে আড়াল করে ফেলা হয়।

কিভাবে গঠন করা হলো শরীয়তপুর জেলা? কারা কী ভূমিকা রেখেছেন? এসব ইতিহাস জানলে খুব সহজেই জেলাবাসী বিশেষ করে আজকের প্রজন্ম জানতে পারবে শরীয়তপুর জেলা গঠনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবদানের কথা এবং কী করে জেলার প্রস্তাবিত সদর দফতর পরিবর্তন করা হয়।


পূর্ব মাদারীপুরের পাঁচটি থানা (ভেদরগঞ্জ, ডামুড্যা, গোঁসাইরহাট, নড়িয়া ও পালং) নিয়ে নতুন মহকুমা অনুমোদন হওয়ার পরপরই বঙ্গবন্ধুকে অভিনন্দন জানানোর জন্য জাতীয় নেতা আবদুর রাজ্জাকের নেতৃত্বে অ্যাডভোকেট আবিদুর রেজা খান, লাকার্তার চুন্নু মিয়া ও কবির শিকদার, সামিউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী, নারায়ণপুরের আবদুর রশিদ মুন্সিসহ কয়েকজন বাকশাল অফিসে যাই। বঙ্গবন্ধুর সাথে সাক্ষাতকালে তিনি আবদুর রাজ্জাককে উদ্দেশ করে বলেন, ‘মহকুমা তো অনুমোদন দিলাম কিন্তু সদর দফতর কোথায় করবি?’ রাজ্জাক সাহেব উত্তরে বললেন, ‘আপনি তো আমাদের এলাকা সবই চিনেন, আপনি যেখানে বলবেন সেখানেই হবে।’ এ সময় বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘রাজ্জাক, ফাতেমা জিন্নাহর ইলেকশনের সময় ওই যে একটা বিরাট দীঘি তুমি দেখাইলা, ওখানে হিন্দু সম্প্রদায়ের অনেক লোকজন ছিল, মেলা হতো, পাঁঠা বলি হতো, ওখানকার হিন্দুরা প্রায় সবাই নাকি ভারত চলে গেছে। ওখানে অনেক পরিত্যক্ত বাড়ি, জায়গা রয়েছে। ওখানে সদর দফতর হলে মধ্যখানে হয়।’ রাজ্জাক সাহেব বললেন, ওই জায়গার নাম মহিষার দিগাম্বরী খোলা। তখন বঙ্গবন্ধু বললেন, ওখানে সদর দফতর করো। সংস্থাপন বিভাগের একজন অফিসার নিয়ে জায়গাটি দেখিয়ে আনো। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে কিছুদিন পর তিনি সংস্থাপন বিভাগের একজন উপসচিবসহ এলাকা পরিদর্শন করেন এবং বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে মহিষারে নতু ন মহকুমার সদর দফতর হবে বলে জনসমক্ষে ঘোষণা করেন। কিন্তু সরকার নতুন মহকুমার সদর দফতর ঘোষণা দেয়ার আগেই কুচক্রী মহল ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে। থেমে যায় নতুন মহকুমা গঠনের কার্যক্রম।

বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ অনুযায়ী মহিষারে যাতে সদর দফতর না হয়, সে জন্য ১৯৭৭ সালে কিছুসংখ্যক লোক নতুন মহকুমার সদর দফতর ডামুড্যাতে করার জন্য দাবি তোলে। তৎকালীন ঢাকা বিভাগীয় কমিশনার ডামুড্যায় সদর দফতর করার দাবির ব্যাপারে ফরিদপুর জেলা প্রশাসকের মতামত চেয়ে পত্র দেন। চিঠির জবাবে জেলা প্রশাসক ডামুড্যাতে বিদ্যমান অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা থাকার যুক্তি দেখিয়ে সেখানে সদর দফতর করার পক্ষে জোরালো মত দেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ডামুড্যাতে সদর দফতর করার বিষয় আলোচনার জন্য কেবিনেট মিটিংয়ের অ্যাজেন্ডাভুক্ত করা হয়।


এ দিকে নতুন মহকুমার সদর দফতর ডামুড্যাতে হচ্ছে বলে গুজব ছড়িয়ে পড়লে ভেদরগঞ্জ, নড়িয়া ও পালং থানার জনগণ মহিষারে সদর দফতর করার দাবিতে এক হয়ে যায়। সদর দফতর ‘এক কোণে’ ডামুড্যাতে করার তীব্র বিরোধিতা করে তারা মধ্যবর্তী স্থান হিসেবে মহিষারে সদর দফতর করার পক্ষে ঐকমত্য পোষণ করেন। এসব থানার গণ্যমান্য লোক, পদস্থ সরকারি কর্মকর্তা ও বিশিষ্ট ব্যবসায়ীরা মহিষারে সদর দফতর করার দাবি জানিয়ে সরকারের কাছে আবেদন করেন এবং টেলিগ্রাম পাঠান। এ ছাড়া ভেদরগঞ্জ, নড়িয়া ও পালং থানার সব ইউপি চেয়ারম্যানের স্বাক্ষরিত এক আবেদনেও মহিষারে সদর দফতর করার দাবি জানানো হয়। আবদুর রাজ্জাক তখন কারাগারে ছিলেন। তিনি বলেছিলেন, বঙ্গবন্ধুর নির্ধারিত স্থান মহিষার ছাড়া তিনি অন্য কোথাও সমর্থন দেবেন না।

শেষ পর্যন্ত একটি সাইট সিলেকশন কমিটি গঠনের মাধ্যমে আগের পাঁচটি থানার সাথে জাজিরা থানা যোগ করে মোট ছয়টি থানা নিয়ে নতুন মহকুমা করার প্রস্তাব করা হয়। কমিটি পালং থানার সদর দফতরকে মহকুমার সদর দফতর হিসেবে নির্ধারণ করে এবং ফরায়েজি আন্দোলনের নেতা হাজী শরীয়তুল্লাহর নামানুসারে এই মহকুমার নামকরণ করা হয় ‘শরীয়তপুর’।

অবশেষে ১৯৭৭ সালের ৩ নভেম্বর পূর্ব মাদারীপুরের ছয়টি থানা (ভেদরগঞ্জ, ডামুড্যা, গোসাইরহাট, পালং, নড়িয়া ও জাজিরা) নিয়ে শরীয়তপুর মহকুমার উদ্বোধন করেন খাদ্য মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত উপদেষ্টা আবদুল মোমেন খান। নতুন মহকুমা ঘোষণার পর পূর্ব মাদারীপুর জনকল্যাণ সমিতি পুনর্গঠনের প্রয়োজনে আমাকে এ ব্যাপারে একটি সভা ডাকার দায়িত্ব দেয়া হলো। ১৯৭৮ সালের ১৭ অক্টোবর ঢাকায় সিদ্ধেশ্বরী উচ্চবিদ্যালয়ে এক সভার আয়োজন করি। সভায় ঢাকায় বসবাসকারী ছয় থানার লোকজন মহকুমার উন্নয়ন কর্মকাণ্ড এগিয়ে নেয়ার জন্য মশিউর রহমান শিকদারকে সভাপতি ও আবুজর গিফারী কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর জহুরুল ইসলামকে সাধারণ সম্পাদক করে ৩১ সদস্যবিশিষ্ট ‘শরীয়তপুর মহকুমা জনকল্যাণ সমিতি’ গঠন করা হয়।

মহকুমা হওয়ার মাত্র সাত বছর পর এরশাদের সময় ১৯৮৩ সালের ৭ মার্চ শরীয়তপুর মহকুমাকে জেলায় উন্নীত করা হয়। অতঃপর ১৯৮৫ সালে ঢাকায় জাজিরার সাবেক এমপি আমিনুল ইসলাম দানেশের সভাপতিত্বে জরুরি সভা আহ্বান করা হয়। সভায় কার্তিকপুরের সামিউদ্দিন আহমদ চৌধুরীকে সভাপতি ও আমাকে সাধারণ সম্পাদক করে ৩৩ সদস্যবিশিষ্ট শরীয়তপুর জেলা উন্নয়ন সমিতি গঠন করা হয়। চার বছর পর সাবেক সংসদ সদস্য দানেশকে সভাপতি ও আমাকে সাধারণ সম্পাদক পুনর্নির্বাচিত করা হয়। ১১ বছর একই পদে বহাল থেকে জেলার বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে ভ‚মিকা রাখার চেষ্টা করেছি।

১৯৭৭ সালে জিয়ার সময় শরীয়তপুর মহকুমা সরকারিভাবে ঘোষণা করা হয় এবং ১৯৮৩ সালে এরশাদের সময় তা জেলায় উন্নীত হয়। এর অনেক আগেই বঙ্গবন্ধু নতুন মহকুমার অনুমোদন দিয়েছিলেন, এমনকি মহিষারকে এর সদর দফতর হিসেবে স্থান নির্বাচন করেছিলেন। সে জন্য জেলা গঠনে বঙ্গবন্ধুর অবদানকে স্মরণীয় করে রাখতে প্রয়োজন সরকারি উদ্যোগ গ্রহণের।

প্রধানমন্ত্রী, আমি ১৯৬৬ সালে আওয়ামী লীগে যোগদান করছি। ঢাকার গোপীবাগ-নারিন্দা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ও ৩ নং ওয়ার্ড সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছি। ১৯৯৭ সালে আবদুর রাজ্জাক পানিসম্পদ মন্ত্রী থাকাকালে শরীয়তপুর মহকুমা গঠন ও এর উন্নয়নে ভ‚মিকাসহ বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের স্বীকৃতি হিসেবে আপনার সরকার আমাকে জেলার শ্রেষ্ঠ সন্তান হিসেবে সংবর্ধনা দেয়। এ ছাড়া মহানগর আওয়ামী লীগের একজন কর্মী হিসেবে ১৯৭০ ও ১৯৭৩ সালের জাতীয় নির্বাচনের সময় টিকাটুলির কামরুননেচ্ছা গার্লস হাইস্কুল কেন্দ্রে বঙ্গবন্ধুর নির্বাচনী পোলিং এজেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছি। তাই বঙ্গবন্ধুতনয়া আপনার কাছে শরীয়তপুর জেলাবাসীর পক্ষে আবেদন, অনুগ্রহ করে বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিধন্য শরীয়তপুর জেলা গঠনে বঙ্গবন্ধুর অবদান রেকর্ড করার জন্য সংশ্লিষ্ট বিভাগকে নির্দেশ দিন। একই সাথে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ অনুযায়ী ভেদরগঞ্জের মহিষারে সদর দফতর না হওয়ায় সেখানে তার স্মৃতি ধরে রাখার জন্য, অবহেলিত জেলাবাসীর জন্য সে স্থানে তার নামে একটি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার দাবি জানাই। এতে জেলার মানুষ জেলার জন্য বঙ্গবন্ধুর ভ‚মিকার কথা কৃতজ্ঞতাভরে স্মরণ করবে। অন্য দিকে এলাকার ছেলেমেয়েরা ডাক্তার হয়ে দেশের জন্য ভূমিকা রাখার সুযোগ পাবে।

মো: আজিজুল হক 

লেখক : উপদেষ্টা, শরীয়তপুর জেলা আওয়ামী লীগ; সভাপতি, ভেদরগঞ্জ উপজেলা উন্নয়ন সমিতি


Previous Post Next Post

نموذج الاتصال