বাকরখানি নামকরণ ও ইতিহাস

 

বাকরখানি কিঃ

ময়দার খামির থেকে রুটি বানিয়ে তা মচমচে বা খাস্তা করে ভেজে বাকরখানি তৈরি করা হয়। পুরান ঢাকাবাসীদের সকালের নাশতা হিসেবে অতিপ্রিয় খাবার বাকরখানি। শুধু ঢাকাতেই নয়, চট্টগ্রাম অঞ্চলের বাকরখানিও রসালো ও সুমিষ্ট। ছোট-বড় বিভিন্ন আকারের বাকরখানি পাওয়া যায় পুরান ঢাকায়। বাকরখানির সৃষ্টি আঠারো শতকের মাঝামাঝিতে।

 বাকর খানি ইতিহাস ও নামকরণ:   

বাকরখানি রুটির নামের পেছনে জড়িয়ে আছে এক দীর্ঘ ইতিহাস। লোকমুখে শোনা যায়, জমিদার আগা বাকের তথা আগা বাকির খাঁর নামানুসারে এই রুটির নাম রাখা হয়েছিল। নবাব মুর্শিদ কুলি খাঁর দত্তক ছেলে আগা বাকের প্রখর মেধার অধিকারী এবং যুদ্ধবিদ্যায়ও ছিলেন পারদর্শী। রাজধানী মুর্শিদাবাদের নর্তকী খনি বেগম ও আগা বাকেরের মধ্যে প্রেম ছিল। ঐতিহ্যবাহী বাকরখানি রুটির নামের পেছনেও রয়েছে বাকের-খনির প্রেমের ইতিহাস।  বাকের খাঁর নামানুসারেই বাকলা-চন্দ্রদ্বীপ (পটুয়াখালী-বরিশাল) অঞ্চলের নাম হয়েছে বাকেরগঞ্জ। আগা বাকের ও খনি বেগম থেকে বাকরখানি নামটি এসেছে।

বাকরখানি সম্পর্কে আরো কিছু কথাঃ

বাকরখানির ঐতিহ্যে মুগ্ধ হয়ে কবি প্রতুল মুখোপাধ্যায় তার কবিতার ভাষায় বলেছিলেন- ‘আলু বেচো, ছোলা বেচো, বেচো বাকরখানি/বেচো না বেচো না বন্ধু তোমার চোখের মণি। ঝিঙে বেচো পাঁচ সিকেতে হাজার টাকায় সোনা/হাতের কলম জনম দুঃখী তাকে বেচো না।’ এই চরণগুলোই প্রমাণ করে বাকরখানির ইতিহাস অনেক পুরনো। এই ঐতিহ্যকে রক্ষার জন্য এখনো কয়েক প্রজন্ম এ ব্যবসা ধরে রেখেছে। তবে সেই স্বাদের ও আসল বাকরখানির অভাব থাকলেও এর জনপ্রিয়তা এখনো কমেনি। জানা গেছে, লালবাগ কেল্লার কাছেই প্রথম বাকরখানির দোকান গড়ে উঠেছিল। তা থেকেই আস্তে আস্তে বিভিন্ন এলাকায় বিস্তার লাভ করে। চানখাঁরপুল, নাজিরাবাজার ও বংশাল এলাকায় রাস্তার দুই পাশে চোখে পড়বে পরপর অনেক দোকান। সেখানে বিভিন্ন আকৃতি ও স্বাদের বাকরখানি পাওয়া যায়। এর মধ্যে আছে কাবাব বাকরখানি, চিনি বাকরখানি, ছানা বাকরখানি, খাস্তা বাকরখানি, নোনতা বাকরখানি, পনির বাকরখানি, নারকেল বাকরখানি, ঘিয়ের বাকরখানি, মাংসের বাকরখানিসহ অসংখ্য পদ। সাধারণ বাকরখানির দাম ২ থেকে ৪ টাকা। কাবাব, পনির বা মাংসের বাকরখানির দাম একটু বেশি। বাকরখানি আবার কেজি দরে বিক্রি হয়। প্রতি কেজির মূল্য ১১০ থেকে ১৩০ টাকা। এসব দোকানের বাকরখানিই প্যাকেট করে শহরের অভিজাত এলাকা ধানমন্ডি, উত্তরা, বনানী, গুলশানের ফাস্টফুডের দোকানে সরবরাহ করা হয়। এমনকি পুরান ঢাকা থেকেই ভারত ও শ্রীলঙ্কাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করা হয়। চকবাজার, আমলিগোলা, নাজিরাবাজার, বংশাল, ইসলামবাগ, হাজারীবাগ, আবুল হাসনাত রোড, সিদ্দিকবাজার, বনগ্রাম, লক্ষ্মীবাজার, সূত্রাপুর, একরামপুর, গেণ্ডারিয়া, নারিন্দা, দয়াগঞ্জ ও কাগজীটোলাসহ পুরান ঢাকার প্রায় সব এলাকায় রয়েছে বাকরখানির দোকান। পুরান ঢাকায় হাজারো পরিবার খুঁজে পাওয়া যায় যারা বংশপরম্পরায় বাকরখানি তৈরি ও বিক্রির সঙ্গে জড়িত আছে দীর্ঘদিন ধরে। সুস্বাদু এই খাবারের কথা বলতে গিয়ে এখনো পুরান ঢাকার মানুষ আগা বাকের ও খনি বেগমের প্রেমকাহিনীর কথা স্মরণ করেন। পুরান ঢাকার বনেদি পরিবারগুলো তাদের বিয়ে বা বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে মালাই-মাখনের বাকরখানির অর্ডার এখনো দিয়ে থাকে বলে জানালেন বংশালের বাকরখানির কারিগর আলাউদ্দিন। পুরান ঢাকার বাসিন্দারা সাধারণত ভোজনবিলাসী ও খাদ্যরসিক।  যে কারণে এই ফাস্টফুডের যুগেও সগৌরবে টিকে আছে ঐতিহ্যবাহী খাবার বাকরখানি।  জানা যায়, মোগল আমলের খাবারগুলোর মধ্যে জনপ্রিয় ও প্রচলিত ছিল পুরান ঢাকার বাকরখানি। এটি বাংলাদেশ, আফগানিস্তান ও রাশিয়ার মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায় সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায়। প্রকৃত বাকরখানি খাঁটি ময়দা, ঘি, মাওয়ার খামির ও দুধ দিয়ে তৈরি করা হয়।

বাকরখানি নির্ভেজাল খাবারঃ

পত্রিকা সুত্রে জানা যায়, পুরান ঢাকার লক্ষ্মীবাজারের বাসিন্দা লিটন জানান, ‘সকালে ঘুম থেকে উঠে গরম গরম চায়ের সঙ্গে বাকরখানিতেই আমাদের নাশতা হয়ে যায়। এ এক অন্যরকম আচার-ঐতিহ্য।’ তিনি আরও জানান, ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য তৈরি করা হচ্ছে নোনতা বাকরখানি। দুধ দিয়ে ভিজিয়ে বা চা দিয়ে যে কোনো রোগী এটি সহজেই খেতে পারেন। বাকরখানির কারিগররা জানান, বর্তমানে শত শত খাদ্যপণ্যের ভিড়ে কোনটা ভালো আর কোনটা ভেজাল তা বোঝা কঠিন। কিন্তু বাকরখানিতে কোনো ভেজাল নেই। তা ছাড়া তৈরির সময় যদি ভেজাল কিছু মেশানোও হয় তাহলে উপকরণ তথা তেল, ময়দা, চিনি বা সোডা এগুলো আগুনে পুড়ে জমাট বাঁধবে না। জমাট হলেও তা হয়ে যাবে শক্ত। ফলে তা আর খাওয়ার উপযুক্ত থাকবে না।

বাকরখানি রেসিপি:

বাকরখানি রুটি চায়ের সাথে খাওয়ার প্রচলন বেশী। এছাড়াও মাংসের সাথে,হোক সে গরু বা খাশীর অথবা মুরগীর, সংগে বাকরখানি রুটি এ যেন সোনায় সোহাগা। ক্ষীর এবং পায়েশের সাথেও এই রুটি পরিবেশন করা হয়ে থাকে।

বাকরখানি যেসব এলাকায় পাওয়া যায়:

ঢাকার সোয়ারীঘাট থেকে ট্রলারে করে জিঞ্জিরার পরে বরিশুর নামে একটি এলাকার বাকরখানি রুটির বেশ নাম ডাক সারা ঢাকা জুড়ে। পুরনো ঢাকার লালবাগ, নাজিমুদ্দিন রোড, সিক্সা বাজার এবং চাঁনখারপুল এলাকা বাকরখানি রুটি তৈরীর জন্য বিখ্যাত। এছাড়াও জিন্দাবাহার, কসাইটুলী, নাজিরা বাজার, নবাব বাড়ী, আওলাদ হোসেন লেন, নবরায় লেন, সূত্রাপুরসহ ঢাকার নাম না জানা অলিতে গলিতে বাকরখানি রুটির দোকান রয়েছে।

বাকরখানির মূল্য

বাকরখানি কেজি দরে বিক্রয় করা হয়। প্রতি কেজির মূল্য ১১০ টাকা থেকে ১৩০ টাকা পর্যন্ত হয়ে থাকে। ৩৫ টি থেকে ৪০ টি পর্যন্ত ধরে প্রতি কেজিতে। একজন সর্বোচ্চ ২ টি থেকে ৩ টি রুটি খেতে পারে। এই হিসাব মতে ৩ থেকে ৪ সদস্যের একটি পরিবারের ৪ থেকে ৬ দিনের সকালের নাস্তা মাত্র ১৩০ টাকার মধ্যে সেড়ে যাবে। বাকরখানি রুটি খুচরা হিসেবেও বিক্রয় করা হয়ে থাকে। প্রতি পিস দাম পড়বে ৩ থেকে ৮ টাকা পর্যন্ত।

সত্যিকার অর্থে বাকরখানি পুরনো ঢাকার একটি ঐতিহ্যবাহী খাবার। বাকরখানি রুটি ঢাকার বাইরেও অর্ডার মোতাবেক সরবরাহ করা হয়ে থাকে।

বাকরখানি রেসিপি: মিষ্টি বাকরখানি

ময়দা ৪ কাপ,

চিনি ১ কাপ,

ঘি ২-৩ টেবিল চামচ,

পানি ১ কাপ,

লবণ ১ চা-চামচ,

চিনি গুঁড়া আধা কাপ,

গুঁড়া দুধ ৩ টেবিল চামচ,

পানি পরিমাণমতো,

মাখন আধা কাপ।

প্রণালি :

একটি বাটিতে ময়দা, তেল, চিনি, গুঁড়া দুধ নিয়ে পানি দিয়ে ভালোভাবে মেখে নিতে হবে।

সামান্য ঘি মেখে ১ ঘণ্টা ঢেকে রাখতে হবে।

রুটি বেলে গলানো মাখন লাগিয়ে চার ভাঁজ করে ১৫-২০ মিনিট রেখে দিতে হবে।

এরপর চার কোনা একসঙ্গে করে গোলভাবে আবার রুটি বেলতে হবে।

প্রি-হিট ওভেনে ২০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপে ৮ মিনিট বেক করে নিতে হবে অথবা ননস্টিক প্যানে সামান্য মাখনে ভেজে নিতে হবে।

চিনি ও পানি জ্বাল দিয়ে সিরা তৈরি করে নিতে হবে।

ভাজা বাকরখানি সিরায় দিয়ে তুলে নিতে হবে।

বাসায় বাকরখানি তৈরী:

উপকরণ

ময়দা- ১ কাপ

লবণ- আধা চা চামচ কিংবা স্বাদ মতো

সয়াবিন তেল- প্রয়োজন মতো

ডালডা/ ভেজিটেবল সর্টেনিং/ ঘি- ১/৪ কাপ

প্রস্তুত প্রণালি ঃ

একটি বাটিতে ময়দার সঙ্গে লবণ ও ১ টেবিল চামচ সয়াবিন তেল মিশিয়ে নিন। অল্প অল্প পানি মিশিয়ে ডো তৈরি করুন। ডো যেন নরম হয়। একটি ভেজা কাপড় দিয়ে ৩০ মিনিট ঢেকে রাখুন ডো।  

অন্য আরেকটি পাত্রে আধা কাপ সয়াবিন তেলের সঙ্গে ভেজিটেবল সর্টেনিং অথবা ডালডা মেশান। ভেজিটেবল সর্টেনিং ডালডার চাইতে স্বাস্থ্যসম্মত। এটি পেয়ে যাবেন সুপার শপগুলোতে। চাইলে এগুলোর বদলে ঘি ব্যবহার করতে পারেন। মিশ্রণটি মাইক্রোওয়েভ ওভেনে কিংবা চুলায় গলিয়ে নিন ভালো করে।

রুটি বেলার জন্য একটি বড় জায়গা নির্বাচন করুন। জায়গাটি পরিষ্কার করে তেলের মিশ্রণটি ঘষে নিন। রুটি বেলার বেলুনিতেও মেখে নিন। রুটি বেলতে হবে বড় ও পাতলা করে। যতটুকু সম্ভব পাতলা করে বেলে হাতে তেলের মিশ্রণ নিয়ে ছড়িয়ে দিন রুটির ওপর। পুরো রুটিতেই মাখতে হবে এটি। একইভাবে উপরে ময়দা ছিটিয়ে মেখে নিন। এভাবে আরও এক লেয়ারে তেলের মিশ্রণ ও ময়দা ছড়িয়ে দিন। এবার রুটি মাঝ বরাবর ভাঁজ করুন। এক কোণার সঙ্গে আরেক কোণা মিলিয়ে মাঝ বরাবর ভেঙ্গে ভাঁজ করতে হবে। ভাঁজ করার পর অর্ধেক চাঁদের মতো দেখতে হবে রুটিটি। আগের মতো প্রথমে তেল ও পরে ময়দা ছিটিয়ে নিন ভাঁজ করা রুটির উপর। দুই লেয়ারে ময়দা ও তেল দিতে হবে। এবার নিচ থেকে দুই কোণা টেনে মাঝে নিয়ে আসুন। মাঝের ফাকা অংশটি টেনে লাগিয়ে দিন। আবারো তেলের মিশ্রণ ও ময়দা দিন দুই লেয়ারে। শেষ ভাঁজটি করুন তিনদিক থেকে কোণা টেনে মাঝে নিয়ে এসে। উপরের অংশ থেকে ভাঁজ করে রোল করে নিন। এবার ছোট ছোট করে লেচি কেটে নিন রোল থেকে। লেচি কাটার পর চারপাশ থেকে অগোছালো অংশগুলো টেনে টেনে ভেতরে নিয়ে আসুন। একদিক থেকে আনবেন। একটি অংশ যেন মসৃণ থাকে। লেচি সামান্য বেলে নিন। খুব বেশি মোটা বা পাতলা করবেন না। ছুরির সাহায্যে কয়েকটি দাগ কেটে নিন উপরে।  

বেকিং ট্রেতে একটি একটি করে বাকরখানি রাখুন। সামান্য ফাঁকা করে রাখবেন যেন একটির সঙ্গে আরেকটি লেগে না যায়। ৩৫০ ডিগ্রি ফারেনহাইটে প্রি হিট করা ওভেনে ৩০ মিনিট বেক করুন। চুলায় তৈরি করতে চাইলে  একটি হাড়িতে পর্যাপ্ত পরিমাণ বালি কিংবা লবণ নিয়ে মাঝে স্ট্যান্ড বসিয়ে দিন। মাঝারি আঁচে ১০ মিনিট ঢেকে হাড়ি গরম করুন। গরম হাড়ির মধ্যে বাকরখানি দিয়ে দিন একটি পাত্রে। একদম কম আঁচে ৩৫ মিনিট রেখে দিন। তৈরি হয়ে যাবে মজাদার বাকরখানি!



তথ্যসুত্রঃ বাংলাদেশ প্রতিদিন , ঢাকা অনলাইন

Previous Post Next Post

نموذج الاتصال