নোবেল পুরষ্কার

 

নোবেল ! সংক্ষিপ্ত পরিচয়ঃ 



যার নামে নোবেল পুরষ্কার তিনি একজন বিজ্ঞানী ছিলেন। বিজ্ঞানী নোবেলের পুরো নাম হচ্ছে আলফ্রেড বের্নহার্ড নোবেল। ১৮৩৩ সালের ২১ অক্টোবর ইউরোপের দেশ সুইডেনের রাজধানী স্টকহোমে তাঁর জন্ম হয়। তাঁর বাবার নাম ছিল ইমানুয়েল নোবেল। তিনি একজন ব্যবসায়ী। নোবেলের ছেলেবেলা মোটেও ভালো কাটেনি। কারণ নোবেলের জন্মের বছরই তাঁর বাবা ব্যবসায় দেউলিয়া হয়ে যান। তিনি পরিবার রেখে ভাগ্যের সন্ধানে দেশ-বিদেশে ঘুরতে থাকেন।

অবশেষে তিনি সেন্ট পিটার্সবার্গে একটি মেকানিক্যাল ওয়ার্কশপ প্রতিষ্ঠা করতে সমর্থ হন। অবস্থা মোটামুটি ভালো হলে তিনি ১৮৪২ সালে পরিবারকে তাঁর কাছে নিয়ে যান। তখন থেকে সেন্ট পিটার্সবার্গই হয়ে ওঠে নোবেলের শহর। বেশ ভালো সময় কাটতে থাকে সেখানে। সেন্ট পিটার্সবার্গে বসে থাকেননি নোবেল। ১৮৫০ সালের দিকে তিনি পাড়ি জমান ফ্রান্সে। সেখানে প্যারিসে অবস্থিত টি জুলস পিলৌজ নামক একটি গবেষণাগারে কাজ শুরু করেন। তিনি সেখানে প্রতিষ্ঠা করেন নোবেল কোম্পানি নামক একটি অস্ত্রের কারখানা।

১৯৫৩ সালের দিকে ক্রিমিয়া যুদ্ধ শুরু হলে বেশ লাভ করে তাঁর কোম্পানি। কিন্তু যুদ্ধের শেষদিকে অর্ডার উঠে যাওয়ায় তাঁকেও তাঁর বাবার মতো দেউলিয়া হতে হয়। এভাবে উত্থানের পর হঠাৎ পতনে বেশ বিমর্ষ হয়ে পড়েন তিনি। তবে এতেই দমে যাওয়ার মতো ছেলে ছিলেন না আলফ্রেড নোবেল। তিনি জানতেন, তিনি পারবেন। এই পতনের পর তিনি মনোযোগ দেন নতুন পণ্য উৎপাদনের দিকে। তাঁর এই ঝোঁকই তাঁকে ডিনামাইট আবিষ্কারের পথে নিয়ে যায়।

১৮৬২ সালের দিকে নাইট্রোগ্লিসারিন জাতীয় পণ্য উৎপাদনের কথা চিন্তা করেন এবং গবেষণা শুরু করেন। প্রথম উৎপাদন করেন ব্লাস্টিং অয়েল নামক এক প্রকারের বিস্ফোরক। এরপর ‘ব্লাস্টিং ক্যাপ’ নামক নাইট্রোগ্লিসারিন বিস্ফোরণের ট্রিগার উৎপাদন করেন।

১৮৬৪ সালে স্টকহোমে এ কাজে গবেষণার সময় বিস্ফোরণে নোবেলের ছোট ভাই এমিল মৃত্যুবরণ করেন। তবুও দমে যাননি নোবেল। তিনি ‘ব্লাস্টিং ক্যাপ’ নকশার উন্নয়ন করতে থাকেন এবং ১৯৬৫ সালে স্টকহোমে প্রতিষ্ঠা করেন ‘নাইট্রোগ্লিসারিন এবি’। তারপর সুইডেনে থাকা হয়নি আর বেশি দিন, চলে আসেন জার্মানিতে।

হামবুর্গে চালু করেন ‘আলফ্রেড নোবেল অ্যান্ড কোম্পানি’। গবেষণার সময় হামবুর্গের কারখানাতেও বিস্ফোরণ ঘটে। তখন নোবেল চিন্তা করলেন একে আরো নিরাপদ করা দরকার। এর জন্য অনেক পাগলামিও করেন তিনি। যেমন বিস্ফোরণ হলেও মানুষের যাতে কোনো ক্ষতি না হয় তার জন্য তিনি একটি নৌকা নিয়ে চলে যান এলবে নদীতে। সেখানে তাঁর আবিষ্কৃত বিস্ফোরক নিরাপদে বানানোর চেষ্টা চালিয়ে যান।

কাইসেলগুর মিশিয়ে তার নতুন নাম দেন ডিনামাইট এবং ১৮৬৭ সালে এর জন্য পেটেন্ট লাভ করেন। নাইট্রোগ্লিসারিন এবং টিএনটি দিয়ে তৈরি একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন রাসায়নিক বিস্ফোরকটি প্রথমদিকে ‘নোবেল বাস্টিং পাউডার’ হিসেবে বিক্রি হতে থাকে।

ডিনামাইটকে মূলত তার দ্বারা দূর থেকে বৈদ্যুতিক সিগনালের মাধ্যমে বিস্ফোরণ ঘটানো হয়, যা প্রচুর শক্তি নির্গত করে। কম খরচে এবং সহজে পাহাড় ভাঙা, টানেল তৈরি ও খনিতে এবং যুদ্ধে সেতু, শত্রুপক্ষের ভবন, রেললাইন ইত্যাদি উড়িয়ে দিতে ডিনামাইট ব্যবহৃত হতে থাকে, ফলে ক্রমশ ডিনামাইট জনপ্রিয়তা পেতে থাকে এবং নোবেলকে সৌভাগ্য এনে দেয়।

ডিনামাইট বিক্রি করে তিনি প্রচুর অর্থ-বৈভবের মালিক হন। একের পর এক কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করতে থাকেন। এতে তিনি ব্যবসায়ী হিসেবে যেমন প্রসিদ্ধি লাভ করেন, তেমনি বিজ্ঞানী হিসেবেও। তাঁর ঝুলিতে ছিল প্রায় ৩৫০টি পণ্যের পেটেন্ট! তিনি অনুধাবন করেন যে ডিনামাইট শান্তির উদ্দেশে ব্যবহার করা যাবে।

বিজ্ঞানের আবিষ্কারও যাতে হয় মানবিক কল্যাণে, তাই বিজ্ঞানীদের উদ্বুদ্ধ করা এবং পুরস্কৃত করার চিন্তা করেন তিনি। এই সুইডিশ রসায়নবিদ, প্রকৌশলী এবং উদ্ভাবক ১৮৯৬ সালের ১০ ডিসেম্বর ইহলোক ত্যাগ করেন।

নোবেল পুরষ্কার ঃ 

ডিনামাইট আবিষ্কারক বিজ্ঞানী নোবেল ছিলেন নিঃসন্তান। তিনি বলেছিলেন, তাঁর সম্পদ ব্যয় হবে ‘নিরাপত্তা সুরক্ষা’ দেওয়ার জন্য।

এই পুরষ্কার প্রবর্তনের জন্য বিজ্ঞানী আলফ্রেড নোবেল মৃত্যুর আগে দানপত্র বা উইল করে গিয়েছিলেন। ১৮৮৫ সালে উইলে বলা হয়েছিল পদার্থ বিজ্ঞান, রসায়ন ও চিকিৎসা বিজ্ঞানে ‘সবচেয়ে গুরুত্বপুর্ণ আবিষ্কারের’ জন্য এবং অসামান্য অবদানের জন্য সাহিত্যে নোবেল পুরষ্কার দেওয়া হবে। আর মানবকল্যাণ ও শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য দেওয়া হবে শান্তিতে নোবেল পুরষ্কার। 

আলফ্রেড নোবেলের সম্পদ থেকে পাওয়া প্রায় ২২ কোটি ২০ লাখ মার্কিন ডলার দিয়ে তাঁর মৃত্যুর প্রায় তিন বছর পর গড়ে তোলা হয় ফাউন্ডেশন। এই ফাউন্ডেশনের সঙ্গে কাজ করতে সম্মত হয় চারটি প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানগুলো একটি হলো সুইডেনের স্টকহোমের ক্যারোলিনস্কা ইনস্টিটিউট। তারা দেবে চিকিৎসা বিজ্ঞানে নোবেল। সুইডিশ একাডেমি দেখবে সাহিত্যের নোবেল। রয়াল একাডেমি দেবে পদার্থবিজ্ঞান ও রসায়নে নোবেল  আর নরওয়েজিয়ান নোবেল কমিটি দেবে শান্তিতে নোবেল পুরষ্কার। ১৯০১ সাল থেকে এ পুরষ্কার দেওয়া শুরু হয়। ১৯৬৯ সাল থেকে অর্থনীতিতেও নোবেল পুরষ্কার দেওয়া হচ্ছে। এই পুরষ্কারের অর্থ দেয় সুইডেনের কেন্দ্রীয় ব্যাংক । ব্যাংকটি তাদের ৩০০ বছর পুর্তি উপলক্ষে এ পুরষ্কার দেওয়া শুরু করে। 

নোবেল পুরষ্কারের ক্ষেত্রে সবকিছু সমতল ছিলোনা কিছুটা বিপত্তিও  ছিলো। ১৮৮৫ সালের ঐ উইলে তিনি উল্লেখ করে যাননি, কোন প্রতিষ্ঠান বা কারা পুরষ্কারটি দেবে।  উইল প্রকাশের পর অনেকেই অবাক হয়েছিলেন। এমনকি এই উইলের বিরোধিতা করেছিলেন সুইডেনের তৎকালীন রাজা। পরিবারের অন্য সদস্যরা নোবেলে উইলের সিদ্ধান্তের বিরোধী ছিলেন। তাঁর দুই ভাতিজা তো উইলটি উল্টে দেওয়ারও চেষ্টা করেন। তৎকালীন সুইডেনের রাজ দ্বিতীয় অস্কার বলেছিলেন, বিজ্ঞানী নোবেল দেশপ্রেমিক ছিলেন না। 

নোবেল পুরস্কার সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ও প্রশ্নোত্তর

নোবেল পুরষ্কার দেওয়া শুরু হয় : ১৯০১ সালে ।

প্রতিবছর আনুষ্ঠানিকভাবে নোবেল পুরষ্কার দেওয়া হয় : ১০ ডিসেম্বর (আলফ্রেড নোবেলের মৃত্যু দিবস)

নোবেল পুরস্কারের অর্থমূল্যঃ ১ কোটি ক্রোনার (১৪ লাখ ২০ হাজার ডলার)

প্রথম ৫টি ক্ষেত্রে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হতোঃ পদার্থ, রসায়ন, চিকিৎসাশাস্ত্র, শান্তি ও সাহিত্য)

অর্থনীতিতে প্রথম নোবেল পুরষ্কার দেওয়া হয়ঃ ১৯৬৯ সালে। 

নোবেল পুরস্কার প্রদানকারী সংস্থা:  ৪টি: 

শান্তি – নোবেল কমিটি অব দ্য নরওয়েজিয়ান পার্লামেন্ট (নরওয়ে)

সাহিত্য – সুইডিশ একাডেমি 

পদার্থ, রসায়ন, ও অর্থনীতি – রয়্যাল সুইডিশ একাডেমি অব সায়েন্স

চিকিৎসা – ক্যারেলিনস্কা ইনস্টিটিউট (সুইডেন)

এ পর‌্যন্ত নোবেল পুরস্কার প্রদান করা হয়নি: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারনে সাল  ১৯৪০, ১৯৪১, ১৯৪২

রাজনীতিবিদ হয়েও সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান: উইনস্টন চার্চিল, ব্রিটেন (The History of the second world war: 1953

দার্শনিক হয়েও অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার পান: ড্যানিয়েল ক্যাহনেম্যান, যুক্তরাষ্ট্র (২০০২)

শান্তিতে যে সংস্থা সর্বাধিক তিনবার নোবেল পুরষ্কার পেয়েছে: আন্তর্জাতিক রেডক্রস কমিটি (১৯১৭, ১৯৪৪, ১৯৬৩)

এশিয়া তথা উপমহাদেশের প্রথম নোবেল বিজয়ী: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৯১৩, সাহিত্য)

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কোন কাব্যগ্রন্থের জন্য নোবেল পুরষ্কার পান : Song Offerings (গীতাঞ্জলী)

নোবেল পুরষ্কারপ্রাপ্ত দক্ষিণ এশীয় প্রথম বিজ্ঞানী: সি বি রমন (১৯৩০, পদার্থ)

কোন পরিবারের চার সদস্য নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন: পোল্যান্ডের কুরি পরিবার। মাদাম মেরি কুরি ওপিয়েরে কুরি দম্পত্তি১৯০৩ সালে যৌথভাবে পদার্থ বিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার পান। পরবর্তী সময়ে এই দম্পতির কন্যা আইরিন জুলিয়েট কুরি ও তার স্বামী ফ্রেডরিক কুরি যৌথভাবে ১৯৩৫ সালে রসায়নে নোবেল পুরষ্কার পান। মাদাম মেরি কুরি ১৯১১ সালে রসায়নশাস্ত্রেও নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন।

নোবেল পুরষ্কার বিজয়ী প্রথম বাংলাদেশি: ড. মুহাম্মদ ইউনুস (২০০৬, শান্তি)

কোন মুসলিম মনিষী সর্বপ্রথম নেবেল পুরষ্কার পান: আনোয়ার সাদত

অমর্ত্য সেন কোন বিষয়ে গবেষণা করে নোবেল পান: দুর্ভিক্ষ ও দারিদ্র

একজন রাজনীতিবিদ সাহিত্যে  নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন: চার্চিল

নোবেল বিজয়ী প্রথম মুসলিম মহিলা কে? শিরিন এবাদী

সাহিত্যে নোবেল পুরষ্কার প্রত্যাখান করেছিলেন কে? জ্যাঁ পল সাত্রে 

এশিয়ায় প্রথম নোবেল পুরষ্কার বিজয়ী হলেন? রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

নোবেল শান্তি পুরষ্কার বিজয়ী প্রথম নারী কে? বার্থাটন সুটনার

শান্তিতে প্রথম নোবেল পুরষ্কার পান কে? হেনরি ডুনান্ট

জাতিসংঘের কোন মহাসচিব মরনোত্তর নোবেল পুরষ্কার পেয়েছিলেন? দ্যাগ হ্যামার শোল্ড

Previous Post Next Post

نموذج الاتصال