বাঙালির বৈশাখ ও পান্তা ইলিশ সমাচার
ইফতেখার আমিন

প্রাণের উচ্ছাসে বছর ঘুরে আসে পহেলা বৈশাখ। প্রতিবার এই দিনকে ঘিরে বাঙালি জাতি আয়োজন করে বিভিন্ন অনুষ্ঠান। থাকে নান ধরনের খাবার দাবার। যার মধ্যে হাল আমলে পান্তা ইলিশ আবশ্যক। কিন্তু প্রশ্ন হলো বৈশাখের সঙ্গে পান্তা ইলিশ খাওয়ার কি সম্পর্ক? তাও আবার মাটির পাত্রে!

বৈশাখের উৎসবের সঙ্গে পান্তা ইলিশের সম্পর্ক জানতে হলে বৈশাখ আয়োজনের ঐতিহ্যগত দিকটি জানা জরুরী। কেননা এই পহেলা বৈশাখ কি করে বাঙালি জাতির উৎসবে পরিণত হলো সেই ইতিহাসের দিকে চোখ ফেরালেই এই পান্তা ইলিশের আবশ্যকতার বিষয়টি পরিষ্কার হবে বলে মনে করি।

১৫৫৭ সালে মোঘল সম্রাট আকবর বাংলা সনের প্রবর্তন করেন। এটিকে বলা হয় ‘সন-ই-এলাহী’। মোট বারো মাসের সমন্বয়ে এই সন। মূলত: কৃষকের কাছ থেকে খাজনা আদায়ের সুবিধার্থে বাংলা সনের আবিষ্কার। বৈশাখ বাংলা সনের প্রথম মাস। ১৯৬৩ সালে আকবরের সভাসদ আবুল ফজল ও আমির সিরাজী বৈশাখের প্রথম দিনটি খাজনা আদায়ের জন্য ধার্য করেন। কারণ এ সময়  কৃষক ঘরে নতুন ফসল তোলে। আর্থিক দিক থেকে সচ্ছল থাকে, ধার দেনা শোধ করে। মনের আনন্দে নতুন জিনিস পত্র কেনে। বকেয়া খাজনা পরিশোধ করে। ব্যবসায়ীরা আগের বছরের বকেয়া আদায় করে হিসাব নিকাষ বুঝিয়ে নতুন হিসেবের খাতা খোলে অর্থাৎ হিসাবের খাতা  করে হাল নাগাদ। এই হালখাতাকে ঘিরেই মূলত উৎসবে রুপান্তরিত হয় পহেলা বৈশাখ। এদিন সকালে বিন্নি ধানের খই, দই, চিড়া, মুড়ি, মিষ্টি বিভিন্ন খাবার দিয়ে আপ্যায়নের রেয়াজ শুরু হয়। তখন ব্যবসায়ীরা বৈশাখের দিনে ক্রেতাদের মিষ্টিদ্রব্য দিয়ে আপ্যায়ন করত। সোনার দোকানগুলোতে এখনও ঐতিহ্যগত আনন্দের ধারাটি বজায় রেখেছে। ক্রমে এই হালখাতা উৎসবটিই বাঙালির বৈশাখ উৎসবে পরিণত হয়।

বৈশাখ উৎসব কি কেবল বাঙালির?

রাজা যায়, রাজা আসে। নতুন নতুন অব্দ যায় অব্দ আসে। বঙ্গাব্দ, মৌযাব্দ,হুনান্দ, কনিষ্কান্দ, ত্রিপুরাব্দ, হর্ষাব্দ, হোসনি অব্দ (সুলতান হুসেন শাহ), চৈতন্যব্দ, বৈষ্ণাব্দ, দানেশমন্দ সন, কত কত অব্দ দেখল অঙ্গ-বঙ্গ-পুন্ড্রু-সুক্ষ-সমতট-রায়-গৌড়ি-হরিকেল এর এই পবিত্র মাটি। রাজা শশাংকের বনানো তখনকার চলতি বঙ্গাব্দকেই আকবরের সভাসদেরা গ্রহণ করেছিলেন নাকি বঙ্গাব্দ নামটি তাঁরাই দিয়েছিলেন কেন জানে!

এ দিন কি শুধুই আমাদের? তাহলে দক্ষিণ ভারতে এই একই দিনে কি উৎসব করে ওরা? সারা ভারত বর্ষ জুড়ে এই একই দিনে কি উৎসব করে ওরা? আর বাংলা থেকে সুদূর পাঞ্জাবে যে উৎসবের নাম ‘নয়া সাল’ বা ‘বিছাখী’ কেন? ওদের মাসগুলোর নাম:

১. বিছাগ (আমাদের বৈশাখ) 

২. জেঠ (আমাদের জৈষ্ঠ)

৩. আ’ঢ় (আমাদের আষাঢ়)

৪. শাওন (আমাদের শ্রাবণ)

৫. ভাদো (আমাদের ভাদ্র)

৬. আশুন (আমাদের আশ্বিন)

৭. কাত্তাক (আমাদের কার্তিক)

৮. মা’আঘর (আমাদের অগ্রহায়ণ)

৯. পো’হ (আমাদের পৌষ)

১০. মাঘ (আমাদের মাঘ)

১১. ফাগুন (আমাদের ফাল্গুন)

১২. চেত (আমাদের চৈত্র)

এটা কেবল নামের আশ্চর্য মিল নয়, আসলে বোধ হয় একই নববর্ষের উৎসব করি পাঞ্জাব থেকে আসাম পর্যন্ত আমরা সবাই। কারণ এই সময়ে নতুন ফসল ওঠে বলে। অবশ্য অঞ্চল বিশেষে প্রত্যেক জাতি তাদের নিজস্ব বৈচিত্রময় সাংস্কৃতিক সম্ভার নিয়ে এই দিনে উৎসবে মেতে ওঠে। কিন্তু ইতিহাসের দিকে আলোকপাত করলে বাঙালির বৈশাখ উৎসবে হাল আমলে যুক্ত হওয়া রমনার পান্তা ইলিশের অস্তিত্ব নেই।

ষাটের দশকের শুরুতে আমাদের ছায়ানট সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের জন্ম দিয়েছেন পহেলা বৈশাশের রমনার বটমূলে প্রভাতী অনুষ্ঠান দিয়ে। তাঁরা তখন হয়তো কল্পনাও করেননি শীগগিরই সে অনুষ্ঠান বাঙালির প্রধানতম উৎসবের একটি হয়ে উঠবে। কিন্তু আনুষ্ঠানিকভাবে ছায়ানটের বৈশাখ উৎসবের শুরু থেকে কিন্তু এই পান্তা ইলিশ খাওয়া রেওয়াজটি ছিল না। আর ভাত দৈনিক খাদ্যভাসের তালিকায় থাকলেও বৈশাখ উৎসবের ইতিহাস পর্যালোচনায় তার উপস্থিতি নেই। বৈশাখে আপ্যায়নে মূলত মিষ্টি জাতীয় খাদ্য ও দই, মুড়ি, মুড়কির প্রচলন ছিল। যতদূর জেনেছি ১৯৮৩ সালে পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানে এই পান্তা ইলিশের সংযোজন ঘটে। তখন দৈনিক জনকণ্ঠের সাংবাদিক বোরহান আহমেদ এই পান্তা ইলিশ যুক্ত করার উদ্যোগ নেন।

পহেলা বৈশাখ উদযাপনের কোন ঐতিহ্য বা সংস্কৃতি থেকে এ ধরনের উৎসবী খেয়ালি চিন্তার উদ্ভব তা জানিনা। এমন লেখাও চোখে পড়েছে যেখানে পান্তা ইলিশের উদ্যোগের ইতিহাসের রচনা করা হয়েছে অত্যন্ত দম্ভভরে, যেন এটি একটি বিশাল মহান কাজ। যা বাংলা সংস্কৃতি করেছে সমৃদ্ধ আর সেই সাথে বাঙালিকে করেছে ধন্য!

পহেলা বৈশাখ উদযাপনের সাথে পান্তা ইলিশের কোন সম্পর্ক তো নেই’ই বরং রয়েছে এক ধরনের বৈপরীত্য। কেননা বাংলাদেশের কোন কোন অঞ্চলের সাধারণ চর্চা সকালে পান্তা ভাত খাওয়া। মূলত: দুপুরে বা রাতে রান্না করা ভাত যাতে সকালবেলা নষ্ট না হয় সেজন্য পানি দিয়ে রেখে খাওয়া হতো। বিদ্যুৎতের অভাবে তখন গ্রামাঞ্চলে খাবার সংরক্ষণের জন্য ফ্রিজ ছিল না। এ কারণেই এটি প্রাধানত গ্রামাঞ্চলের চর্চ। এই পান্তাই আজ পহেলা বৈশাখ উৎসবের অন্যতম বিষয় যার সাথে ঐতিহ্যের কোন মিল নেই। তবে সবচেয়ে মারাত্মক যে বিষয়টি তা হলো পান্তার সাথে ইলিশের সংমিশ্রণ, শুধু মারাত্মক নয়, মমার্ন্তিকও বটে। বছরের প্রথম দিন রমনায় ঘটা করে পান্তা ইলিশ খাবার সংস্কৃতিকে অনেকেই ভালো চোখে দেখেন না। এমকি তারা  বলেছেন, এর সঙ্গে বাংলা সংস্কৃতির কোনো সম্পর্ক নেই। অনেকেই আবার বলেন, শহরে পান্তা ভাত খাওয়া আমাদের ঐতিহ্যবাহী গ্রামীণ সংস্কৃতিকে ব্যঙ্গ করা। এটি শুরু হয়েছিল টাকা কামানোর ধান্দায়, সংস্কৃতিপ্রেমের জন্য নয়। আজকাল শহরের মানুষের মধ্যে এমন একটা ধারণা তৈরি হয়েছে যে, বছরের প্রথম দিনটিতে পান্তা ইলিশ না খেলে বছরটাই মাটি! তবে বছরের এই দিনটির ইলিশপ্রীতি ইলিশের ভবিষ্যত নষ্ট হওয়ার কারণ হিসেবে আশঙ্কা অনেকের মনে। সেই আশঙ্কাকে সত্যি করে দিয়ে কোনো কোনো বছর ইলিশ হালি ২০/২৫ হাজার টাকায় বিক্রির নজিরও রয়েছে!

ইলিশ একটি অভিজাত মাছ। যে মাছ এই দেশ ও জাতিকে আন্তজার্তিকভাবে গৌরবান্বিত করেছে। যে মাছ সম্মানিত মেহমানদের আতিথেয়তার অন্যতম একটি উপাদান। তার সাথে বাধ্য হয়ে খাওয়া পান্তা ভাতকে অপূর্ব সমন্বয় করে বাঙালি সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করার এই নিদারুণ উন্মাদনা সত্যিই ব্যথিত করে। কেননা বাঙালির খাবারের সংস্কৃতির ইতিহাসে কে কবে কোনকালে আনন্দ করে, উৎসব করে বৈশাখে পান্তা ভাতের সাথে ইলিশ খেয়েছে? আর বর্তমানে ইলিশ এদেশের ধনীক শ্রেণি ছাড়া অন্যদের কাছে সোনার হরিণ নয় কি? বাঙালির সার্বজনীন উৎসবে এই ইলিশ পান্তার আহামরি চর্চায় যে শ্রেণিগত বৈষম্যকে প্রকট করে তোলে তা কি মুহূর্তের জন্যও ভাবিত করে না বাঙালিকে?


লেখক পরিচিতি:
ইফতেখার আমিন। জন্ম ১৭ ডিসেম্বর ১৯৮২, জাজিরা, শরীয়তপুর। লেখালেখির শুরু ব্লগিংয়ের মাধ্যমে। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ইতিপূর্বে তাঁর লেখা গবেষণাগ্রন্থ ‘একাত্তরের দালালনামা’ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-এ রেফারেন্স বই হিসেবে অর্ন্তভুক্ত এবং গুণীজন সমাদৃত হয় ।
ইফতেখার আমিন শুধু লেখক নন প্রকাশক ও  তিনি সৃষ্টিশীল প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান শব্দশৈলীর স্বত্তাধিকারী। 
Previous Post Next Post

نموذج الاتصال