বাংলাদেশের জাতীয় বন সুন্দরবন সম্পর্কে জানুন

বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন। 

সুন্দরবনের অবস্থান: খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা জেলায় অবস্থিত পৃথিবীর একক বৃহত্তম প্রাকৃতিক ম্যানগ্রোভ বন হচ্ছে আমাদের সুন্দরবন। বঙ্গোপসাগরের কোল ঘেঁষে এ বন অবস্থিত।

উদ্ভিদ প্রজাতি: সুন্দরী, গেওয়া, কেওড়া, পশুর, বাইন, কাকড়া ইত্যাদি এ বনের প্রধান প্রধান বৃক্ষ প্রজাতি।

বন্যপ্রাণী: এ বনের উল্লেখযোগ্য বন্যপ্রাণী হচ্ছে রয়েল বেঙ্গল টাইগার, হরিণ, বানর, শুকর, কুমির, ডলফিন, গুইসাপ, অজগর, হরিয়াল, বালিহাঁস, গাংচিল, বক, মদনটাক, মরালিহাঁস, চখা, ঈগল, চিল মাছরাঙা ইত্যাদি।

 নদী/খাল: এ বনের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত প্রধান প্রধান নদীগুলো হলো- পশুর, শিবসা, বলেশ্বর, রায়মংগল ইত্যাদি। তাছাড়া শত শত খাল এ বনের মধ্যে জালের মতো ছড়িয়ে আছে।

মাছ: শুধু বৃক্ষসম্পদ নয়, এ বন মৎস্য সম্পদেরও এক বিরাট আধার। ইলিশ, লইট্টা, ছুরি, পোয়া,  রূপচাঁদা, ভেটকি, পারসে, গলদা, বাগদা, চিতরা ইত্যাদি মাছ পাওয়া যায়।

বিশ্ব ঐতিহ্য: সুন্দরবনের ৩ টি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য নিয়ে গঠিত ১,৩৯,৭০০ হেক্টর বনাঞ্চলকে ইউনেস্কো ১৯৯৭ সালে বিশ্ব ঐতিহ্য ঘোষণা করেছে।

সুন্দরবনের নাম নামকরণঃ

 সুন্দরবন নামটি সম্ভবত সুন্দরী বৃক্ষের আধিক্যের কারণে (সুন্দর-) অথবা সাগরের বন (সমুদ্র-বন) কিংবা এ বনভূমির আদিবাসী চন্দ্রবেদে থেকে উদ্ভুত।সাধারণভাবে গৃহীত ব্যাখ্যাটি হল, এখানকার প্রধান উদ্ভিদ সুন্দরী বৃক্ষের নাম থেকেই এ বনভুমির নামকরণ। এছাড়া অন্যান্য মতবাদ হল, ইংরেজ আমলের প্রথম দিকে বিদেশী পর্যটকগণ সুন্দরবনের নানা ধরনের জন্য এই জঙ্গল কে ‘Jungle of Sundory Trees’ নামে আখ্যায়িত করেন। ইংরেজি ‘Sundory’  অর্থ নানা ধরনের। এই  Sundory হাতে সুন্দরীবন এবং তা হতে সুন্দরবন হয়েছে। আবার সমুদ্র তীরে এই বনের অবস্থান বলে এর নাম সমুদ্রবন এবং এই সমুদ্রবনের অপভ্রংশ সুন্দরবন। বাকেরগঞ্জ জেলার ইতিহাস প্রণেতা বেভারিজ এর মতে, এই সুন্ধার কূলের বনবিভাগকে সুন্ধরবন বলা হতো এবং এই নাম সুন্দরবনে পরিণত হয়।

১৯৯৭ সালের  ৬ ডিসেম্বর ইউনেস্কো সুন্দরবনকে বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে ঘোষণা করে। 

সুন্দরবন অঞ্চলের উল্লেখযোগ্য নদ-নদী

বলেশ্বর, সুমতি, ছাপড়াখালি, বড়শেওলা, হারণচীনা, লহ্মীপশুর, মজ্জত, শাকবাড়ে সিঙ্গা, হংসবাগ, দোবেকি, ধানিবুনে, হরিখালি, পাট কোস্টা, বাসে, লাঠিকারা, শিবসা, ব্যয়না, কাসিটানা, দায়াহলড়ি, আড়ভাঙ্গা, ইলিশমারী, জলকি, বিবির মাদে, টেমখানি, চামটা, মধুখালি, পরশকাঠি, ধনপতি, রাগাখালি, কানাইকাঠি, মরিচঝাপি, নেতাই, শাকভাতে, চুনকুড়ি, মারাদি, যুগলবাড়ি, বাদামতলী, ঘাট হারানো, বড়বাড়ে, মুকুলে, বড় মাতলা, তুকুনী, কাঁচি কাটা, পারশেমারী ইত্যাদি।

ম্যানগ্রোভ বনের বৈশিষ্ট্য

ম্যানগ্রোভ (Mangrove)  বলতে সাধারণভাবে জোয়ারভাটায় প্লাবিত বিস্তির্ণ জলাভূমিকে বোঝায়। ম্যানগ্রোভ বন (Mangrove forest), জোয়ারভাটায় বিধৌত লবনাক্ত সমতলভূমি। উষ্ণমন্ডলীয় ও উপ-উষ্ণমন্ডলীয় অক্ষাংশের আন্তপ্লাবিত আবাসস্থলের সমন্বয়ে ম্যানগ্রোভ ইকোসিস্টেম গঠিত। এ আন্তপ্লাবিত জলাভূমি বিভিন্ন স্তরের পারষ্পরিক নির্ভরশীল উপাদানসমূহ যেমন- পানি প্রবাহ, পলি, পুষ্টি উপাদান, জৈব পদার্থ এবং জীবজন্তুর সমন্বয়ে গঠিত।

পৃথিবীতে ১,৮১,০০০ বর্গ কিমি এলাকা জুড়ে ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল বিস্তৃত ছিল। কিন্তু অতি সম্প্রতি এক সমীক্ষায় দেখা যায় যে, এ বনাঞ্চলের আয়তন ১,৫০,০০০ বর্গ কিমি এর নিচে নেমে এসেছে। সমগ্র পৃথিবীর উপকূলীয় আবাসস্থল অতিরিক্ত জনসংখ্যার চাপে জর্জরিত। ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল হতে অতিরিক্ত কাঠ ও মাছ আহরণের ফলে এবং উপকূলীয় ভূমিকে বিকল্প ব্যবহার যোগ্য ভূমি হিসেবে ব্যবহারের ফলে এ বনাঞ্চল হুমকির সম্মুখীন। এ বনের উপর অতি নির্ভরশীলতার ফলে বিগত তিন দশক পূর্বে যে পরিমাণ বনাঞ্চল ছিল তার ৬০-৮০% বা ততোধিক এলাকা হারিয়ে গেছে। অধিকন্তু অন্যান্য দেশেও এ ধরনের গুরুত্বপূর্ণ বন ধ্বংসের পিছনে অতিরিক্ত জনসংখ্যার চাপ ও মানুষের কর্মকান্ডই দায়ী। আন্তপ্লাবিত এলাকা নিয়ে গঠিত বলে ‘ম্যানগ্রোভ’ জলজ, উপকূলীয়, উজানের এবং স্থলজ প্রতিবেশের সাথে পারস্পরিক আন্তক্রিয়ায় জোরালভাবে সম্পর্কিত এবং ইহার ফলে ‘ম্যানগ্রোভ’ বিভিন্ন স্তরের সামুদ্রিক, মিঠাপানি ও ভূমিজাত উদ্ভিদ ও প্রাণীকুলকে বেঁচে থাকতে সহায়তা করে। ম্যানগ্রোভ প্রজাতির বৈচিত্র্যতা বলতে বৃহৎ উদ্ভিদও প্রাণীকুল এবং বহু অজানা ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র উদ্ভিদ প্রাণী ও কীটপতঙ্গের গোষ্ঠির সমন্বয়ে গঠিত সমাজকে বোঝায়।

ম্যানগ্রোভ ব্যবস্থাপনায় ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চলের জীববৈচিত্র্যের একটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো অনেক প্রজাতিই এ বনকে তাদের জীবনচক্রের কোনো না কোনো সময় ব্যবহার করে। ম্যানগ্রোভ একটি বৃহৎপরিসরের ভূ-প্রাকৃতিক, আবহাওয়া ও জলবায়ুগত, পানি এবং মৃত্তিকার অবস্থার উপর বিস্তৃত বলে এর ইকোসিস্টেমে বিচিত্রতা রয়েছে। দেশে দেশে ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চলের সাথে মানুষের একটি নিবিঢ় ও সুন্দর সাংস্কৃতিক সহ অবস্থান রয়েছে। একই সাথে এই বনাঞ্চলের ইকোসিস্টেমে বনের গঠন, উৎপাদন এবং কার্যক্রম গভীরভাবে পরিবর্তনশীলও বটে।

মানুষের নিকট ম্যানগ্রোভ ইকোসিস্টেম এর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অর্থনৈতিক, বস্ত্তগত ও সামাজিক মূল্য রয়েছে। ম্যানগ্রোভ ইকোসিস্টেমকে বরাবরই বিভিন্নভাবে অবমূল্যায়ন করা হয়। কেননা কেবলমাত্র প্রত্যক্ষভাবে প্রাপ্ত দ্রব্যসমূহকে অর্থনৈতিকভাবে মূল্যায়ন করা হয় যা ম্যানগ্রোভের সকল দ্রব্য ও সেবার পরিপূর্ণ মূল্যমানের যৎসামান্য অংশ বিশেষ।

সারা পৃথিবী ব্যাপী গ্রীষ্মমন্ডলীয় অঞ্চলের উষ্ণ ও উপউষ্ণ (Tropical and Sub-tropical) উপকূলীয় এলাকায় ম্যানগ্রোভ জাতীয় বনাঞ্চল দেখা যায়। সাধারণত ৩০০ উত্তর ও ৩০০ দক্ষিণ অক্ষাংশের (lattitude) বরাবর ম্যানগ্রোভ বনের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। যা তাপমাত্রার পার্থক্যের জন্য ম্যানগ্রোভের সীমাবদ্ধতা প্রকাশ করে। যদিও ম্যানগ্রোভ ১০০ সে পর্যন্ত  নিম্ন তাপমাত্রায় বেঁচে থাকতে পারে কিন্তু অতিরিক্ত ঠান্ডায় অসহনীয় এবং ম্যানগ্রোভ চারা বিশেষভাবে তুষার ও ঠান্ডায় সংবেদনশীল। ম্যানগ্রোভ জন্মানোর জন্য সবচেয়ে উপযোগী অঞ্চল হলো আদ্র-ক্রান্তীয় অঞ্চল, যেমন- গঙ্গা, মেকং এবং আমাজানের উপকূলবর্তী ব-দ্বীপ এলাকা (delta region)।

পৃথিবীতে ১০২টি দেশে ম্যানগ্রোভের অস্তিত্ব থাকলেও কেবলমাত্র ১০টি দেশে ৫০০০ বর্গ কিমি এর বেশি ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল রয়েছে। পৃথিবীর সমগ্র ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চলের ৪৩% ইন্দোনেশিয়া, ব্রাজিল, অস্ট্রেলিয়া এবং নাইজার এ অবস্থিত এবং এদের প্রত্যেকটি দেশে সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের ২৫% হতে ৬০% ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল রয়েছে। বাংলাদেশে অবস্থিত ম্যানগ্রোভ বন (সুন্দরবন) পৃথিবীর একক বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন হিসেবে পরিচিত।

ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল প্রাকৃতিক এবং উচচ পুনঃ উৎপাদনশীল একটি ইকোসিস্টেম যা থেকে উপকূলীয় এলাকার জনগোষ্ঠী তাদের দৈনন্দিন জীবনের গুরুত্বপূর্ণ দ্রব্য ও সেবা পেতে পারে। এ ইকোসিস্টেমে প্রধানত বৃক্ষ, বীরুৎ, গুল্ম এবং সামান্য পরিমানে পাম ও লতা জাতীয় উদ্ভিদ রয়েছে। দি ওয়ার্ল্ড কনজারভেশন ইউনিয়ন (আই.ইউ.সি.এন) এর হিসাব মতে পৃথিবীতে ম্যানগ্রোভের ৬১টি প্রজাতি রয়েছে। অধিকাংশ ম্যানগ্রোভ প্রজাতি ১৫টিরও কম পরিবারের অন্তর্গত। অধিকাংশ ম্যানগ্রোভ প্রজাতি রাইজোফোরেসি (Rhizophoraceae), সোনারেসিয়েসি (Sonneratiaceae), এভিসিনিয়েসি (Avicenniaceae) পরিবারভূক্ত। ম্যানগ্রোভ বীজ ও বংশ বিস্তারের অঙ্গ সমূহ (Propagules) জোয়ারভাটার মাধ্যমে উজান ও ভাটি অঞ্চলে বিস্তৃত হয়। জোয়ারভাটার পরিধি এবং ভূ-প্রকৃতি একত্রিতভাবে ম্যানগ্রোভের আড়াআড়ি বিস্তৃতিকে ত্বরান্বিত করে। ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চলের পানিতে লবনের ঘনত্ব জোয়ার-ভাটা দ্বারা পরিবর্তিত হয়। 

সুন্দরবনে নিয়ে প্রশ্ন উত্তরঃ 

বাংলাদেশের অন্তর্গত সুন্দরবনের আয়তন কত| উত্তরঃ প্রায় ৬,০১,৭০০ হেক্টর বা ২৪০০ বর্গমােইল যা দেশের আয়তনের ৪.১৩% এবং বন অধিদপ্তর নিয়ন্ত্রিত বনভূমির ৩৮.১২%। 


সুন্দরবন কয়টি জেলা স্পর্শ করেছেঃ খুলনা, সাতক্ষীরা, পটুয়াখালী ও বরগুনা জেলায় অবস্থিত। 


কোন আন্তজার্তিক সংস্থা সুন্দরবনকে ওয়ার্ল্ড হ্যারিটেজ হিসেবে ঘোষণা করেছে? - ইউনেস্কো


তথ্য সুত্রঃ বন অধিদপ্তর ওয়েবসাইট, বাংলাদেশের জেলা-উপজেলার নামকরণ ও ঐতিহ্য (মোহাম্মদ নূরুজ্জামান)


Previous Post Next Post

نموذج الاتصال