বাংলা সনের জন্ম ইতিহাসের সঙ্গে মোঘল সম্রাট আকবরের নাম জড়িয়ে আছে। বলা হয়, সম্রাট আকবরের সিংহাসন আরোহনের বছরকে (বা বলা হয় দিনকে) স্মরণীয় করে রাখতে সম্রাটের রাজ-জ্যোতিষ আমীর ফতেহ উল্লাহ সিরাজী যে ‘ফসলী’ সন প্রবর্তন করেন, সেটাই বাংলা সন হিসেবে পরিচিত। ‘বঙ্গাব্দ’ বর্তমানে কেবল বাংলাদেশেই প্রচলিত। মূলতঃ বাংলার জন্য উদ্ভাবিত বলেই এই সনকে বাংলা সন বলা হয়।
বাংলা সনের দিনের শুরু ও শেষ হয় সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্তের মধ্যদিয়ে। নিজ অক্ষরেখায় পৃথিবী ঘুরতে যে সময় লাগে তাকে বলা হয় দিন। সাতদিনে হয় এক সপ্তাহ। আর ত্রিশ দিনে একমাস। চাঁদও পৃথিবীর চারিদিকে ঘুরে। পৃথিবীর চারিদিকে ঘুরে আসতে চাঁদের সময় লাগে এক মাস। যা চন্দ্রমাস নামে পরিচিত। যে সন চাঁদের হিসেবে গণনা করা হয় তাকে বলা হয় চন্দ্র সন এবং যে সন সূর্যের হিসেবে গণনা করা হয় তাকে বলে সৌরসন। এই সৌরসনের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে তখনকার প্রচলিত হিজরী সনকে ‘ফসলি সন’ হিসেবে চালু করার মাধ্যমে বর্তমান বাংলা সন বা বঙ্গাব্দের জন্ম হয়। বাংলা সন হিজরী সনেরই সৌররূপ। যা প্রবর্তন করেন মোঘল সম্রাট আকবর। বাংলাদেশের ও বাংলা ভাষার অনুসারী সকল মানুষেরা সাতদিনকে সাতবার বলে। এই সাতবার ও বারোমাসের নামকরণ প্রসঙ্গে আসা যাক।
বাংলা বারোমাস আর বাংলা সাতবারের নামকরণগুলো হয়েছে গ্রহ, উপগ্রহ এবং নক্ষত্রের নামানুসারে। বাংলা সাত বারের নামকরণ হয়েছে নক্ষত্র, গ্রহ ও উপগ্রহের নামে। যেমন বুধ গ্রহ থেকে হয়েছে বাংলা বুধবার। শনি গ্রহ থেকে বাংলা শনিবার। মঙ্গল গ্রহ থেকে বাংলা মঙ্গলবার। শুক্র গ্রহ থেকে বাংলা শুক্রবার এবং বৃহস্পতি গ্রহ থেকে বাংলা বৃহস্পতিবার নামকরণ হয়েছে।
আর নক্ষত্র থেকে বাংলা রবিবার এর নামকরণ এবং উপগ্রহ থেকে বাংলা সোমবারের নামকরণ হয়েছে। কারণ সূর্য একটি নক্ষত্র। আর সূর্য নামক নক্ষত্রের প্রতিশব্দ হলো রবি। সেই রবি নক্ষত্র থেকে বাংলা রবিবারের নামকরণ হয়েছে। তারপর চন্দ্র পৃথিবীর একটি উপগ্রহ। আর চন্দ্রের প্রতিশব্দ হলো সোম। এই সোম উপগ্রহ থেকে বাংলা সোমবারের নামকরণ করা হয়েছে। ভিন্নমতে, রবিবার- রবি বা সূর্য দেবতার নামানুসারে নামকরণ হয়েছে রবিবার। আর সোমবার- সোম বা শিব দেবতার নামানুসারে নামকরণ হয়েছে সোমবার।
প্রাচীনকালে উপমহাদেশে পঞ্জিকা ‘পঞ্চাঙ্গ’ নামেও পরিচিত ছিল। কারণ এতে ছিল পাঁচটি অঙ্গ। যেমন- বার, তিথি, নক্ষত্র, যোগ ও করণ। এই পঞ্জিকা গণনা পদ্ধতি রচিত হয়েছিল আনুমানিক ১৫০০ পূর্বাব্দে। তখন বছরকে ভাগ করা হয়েছিল বারোমাসে। সেই মাসগুলোর নাম ছিল নিম্নরূপঃ (১) তপঃ (২) তপস্যা (৩) মধু (৪) মাধব (৫) শুক্স (৬) শুচি (৭) নভস (৮) নভস্য (৯) ইষ (১০) উর্জ (১১) সহস ও (১২) সহস্য। পরে মহাশূন্যের নক্ষত্রের নামানুসারে বাংলা বারোমাসের নামকরণ হয়েছে।
রাশিচক্রে নক্ষত্র সংস্থাপন চিত্র থেকে সহজে বুঝা যায় যে, প্রাচীনকালে কীভাবে চন্দ্র মাসের নাম করা হতো। সাধারণত পূর্ণিমার পরদিন (প্রতিপদ) থেকে চান্দ্র মাসের সূচনা হত, যে নক্ষত্র পূর্ণিমাস্ত হয় তার নামানুসারে মাসের নাম নির্ধারিত হত। যেমন- বিশাখা নক্ষত্রে পূর্ণিমাস্ত হওয়ার পর যে মাস শুরু তার নাম বৈশাখ। কৃত্তিকা নক্ষত্রে পূর্ণিমাস্ত হলে নতুন মাসের নাম হয় কার্তিক ইত্যাদি। আকাশে চন্দ্রের গতির কারণে প্রতিভাত হয় ‘চন্দ্র-দশা’ এবং যা থেকে আমরা ধারণা করি মাসের। বাংলা সালটির সঙ্গে জ্যোতিষী গণনার সম্পর্ক ছিলো বলে তার প্রত্যেকটি মাসের নামই এক একটি নক্ষত্রের নামে রাখা হয়েছে। যে নক্ষত্রে পূর্ণিমার অস্ত হয়, সেই নক্ষত্রের নামানুসারেই প্রতিটি মাসের নামকরণ করা হয়েছে।
যে চন্দ্র মাসে সাধারণত মৃগশিরা নক্ষত্রের পূর্ণিমার অস্ত হয়, একে মার্গ-শীর্ষ বলে। এই নক্ষত্রযুক্ত মাসটিই আমাদের অগ্রহায়ণ মাস। কিন্তু নক্ষত্রটির নামের সঙ্গে এই মাসটির নামের কোনো সাদৃশ্যই নেই। ফসলি মাস হিসেবে একে অগ্রগণ্য করতে যেয়েই তার নাম হয়েছে অগ্রহায়ণ এবং মূল নামের সঙ্গে তার কোনো সম্পর্কই নেই। কোনো কোনো ভারতীয় ভাষায় তার মূল নামটির ধ্বংসাবশেষ পাওয়া যায়। বর্তমান পাকিস্তানের প্রদেশগুলোতে এই মাসটির নাম মাগর এবং গুজরাটি ও কাচ্চি ভাষায় একে বলা হয় মাক্সার। এই নামটিই সংশ্লিষ্ট নক্ষত্রের সঙ্গে সম্পর্কিত নামের অপভ্রংশ। বাংলা অগ্রহায়ণ মাসটির নাম হিন্দ, মহারাষ্ট্র ও উড়িয়া ভাষায় আগাহান। বাংলাদেশের কথ্য ভাষায় আগন বলে। একই উৎসজাত এ নামটি সম্ভবত একই কারণে বিশেষ বিশেষ অঞ্চলে গৃহীত হয়েছিল।
নববর্ষ অনুষ্ঠানের প্রাচীন ধারার দিকে অনুসন্ধানী চোখে তাকালে এটা দেখা যাবে যে, আজকাল বৈশাখ মাসে নববর্ষের সূচনা ধরা হলেও প্রাচীনকালে এদেশে নববর্ষ শুরু হতো অগ্রহায়ণ মাসে। অগ্রহায়ণ নামটির অর্থের মধ্যেই বছরের প্রথম মাসের ইঙ্গিত রয়েছে। হায়ণ-এর একটি অর্থ হলো বছর। এদিক থেকে অগ্রহায়ণ শব্দের অন্য একটি অর্থ হলো সেরা শস্য বা ধান। অগ্রহায়ণ মাসের নাম এসেছে ‘অগ্রহায়ণী’ নক্ষত্রের নাম থেকে। প্রচলিত লোক বিশ্বাস হলো, অগ্রহায়ণী নক্ষত্রের উদয়ে ধান পাকে। বাঙালির জীবনে নববর্ষ এবং তাকে উপলক্ষ করে উৎসবের সূচনা হয়েছে ফসল উৎপাদনের সূত্র ধরে। আর প্রথমে সে উৎসব পালিত হতো অগ্রহায়ণে, বৈশাখে নয়।
বাংলা সনের বৈশাখ থেকে চৈত্র পর্যন্ত বারোমাসের হিসাব পাওয়া যায়। বাংলা সনের প্রথম মাস বৈশাখ। বিশাখা নক্ষত্রের নামানুসারে বৈশাখ মাসের নামকরণ হয়েছে। বারোমাসে এক বছর হয়- এ অর্থে বার সংখ্যাটি এখানে সম্পূরক বাচক। বারোমাসের ধারণা বাংলা বারোমাসি গানেও নিহিত আছে। কোনো বারোমাসীতে বৈশাখ, কোনোটিতে অগ্রহায়ণ, কোনোটিতে মাঘ মাসকে বছরের প্রথম মাস গণনা করে এরূপ রচিত হয়েছে। মাসে মাসে প্রকৃতি কী রূপ ধারণ করে, মানুষের জীবনে তার কী প্রভাব পড়ে, নর-নারী কীরূপ আচরণ করে ইত্যাদির বিবরণ থাকে বারোমাসিতে। সম্রাট আকবরের রাজত্বকালে এদেশে বাংলা সন, মাস, বার ইত্যাদি রীতিবদ্ধ গণনা প্রবর্তিত হয়। সম্ভবত তখন থেকে বছরের প্রথম মাস হিসেবে বৈশাখের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়। নতুবা আগেও বাংলা মাসের প্রচলন ছিল।
ড. নীহাররঞ্জন রায়ের মতে বাঙালির নববর্ষের উৎসব ছিল ‘নবান্ন’। তাঁর কথায় বৈদিক যুগে বছরের প্রথম মাস হিসেবে ধার্য্য হয় অগ্রহায়ণ। অগ্রহায়ণ মাসেই নবান্ন হতো। মুর্শিদকুলি খাঁ যখন বাংলায় শাসক তখন খাজনা আদায়ের জন্য ধার্য হয় বৈশাখ মাস।
সুতরাং বলা যায় প্রাচীনকাল থেকেই বাংলা মাস গণনার নিয়ম পদ্ধতি চালু রয়েছে। বৈশাখ মাসই যে বর্ষ গণনার প্রথম মাস ছিল তার বহু প্রমাণ বাংলা সাহিত্যে বিদ্যমান। কবি মুকুন্দরামের মঙ্গলকাব্যে তার প্রমাণ মিলে।
গবেষকদের মতে বাংলা সনের মাসের নামগুলো ষোড়শ মহাজনপদের সময় চিহ্নিত মহাকালের নক্ষত্রমন্ডলীর নাম থেকে নেয়া হয়েছে। এক সময় বাংলা ১৬টি মহাজনপদে বিভক্ত ছিল। এ মহাজনপদের প-িত ও জ্যোতির্বিদগণ গ্রহ, নক্ষত্র, তিথি ইত্যাদি পর্যবেক্ষণ ও অনুসন্ধান করে কিছু নক্ষত্রের নামানুসারে বাংলা সনের বাংলা বারোমাসের নামকরণ করেছিলেন। যেমন- বিশাখা নক্ষত্রের নামে হয়েছে বৈশাখ মাস। জ্যৈষ্ঠা নক্ষত্রের নামে হয়েছে জ্যৈষ্ঠ মাস। পূর্বাষাঢ়া বা আষাঢ়া নক্ষত্রের নামে নামকরণ হয়েছে বাংলা আষাঢ় মাসের। শ্রাবণা বা শ্রবণ নক্ষত্রের নামে বাংলা শ্রাবণ মাসের নামকরণ হয়। পূর্ব ভদ্রপদ বা ভাদ্রপদা নক্ষত্রের নামে নামকরণ হয়েছে ভাদ্র মাস। আশ্বিনী বা অশ্বিনী নক্ষত্রের নামে নামকরণ হয়েছে আশ্বিন মাসের। কৃত্তিকা নক্ষত্র থেকে নামকরণ হয়েছে বাংলা কার্তিক মাসের। মৃগশিরা নক্ষত্রের নামে বাংলা অগ্রহায়ণ মাসের নাম হয়েছে অগ্রহায়ণ। এখানে মৃগশিরা নক্ষত্রের নামের বাংলা মাসকে অগ্রহায়ণ বলে- এইজন্য যে, এক সময় ঐ মাস থেকে বছর আরম্ভ হতো বা প্রথম মাস হিসেবে গণনা হতো। অগ্র মানে আগা, আর হায়ণ মানে বছর। অর্থাৎ অগ্রহায়ণ শব্দের অর্থ অগ্রবছর। পূর্বে বছরের প্রথম মাস গণনা করা হতো বাংলা অগ্রহায়ণ মাস থেকে। পরে সম্রাট আকবরের সময় থেকে বাংলা বৈশাখ মাসকে বছরের প্রথম মাস হিসেবে ধরা হয়। তারপর পূষ্যা নক্ষত্র থেকে হয়েছে বাংলা পৌষ মাস। আর মঘা নক্ষত্রের নামে বাংলা মাঘ মাসের নামকরণ হয়েছে। এমনিভাবে পূর্ব ফালগুনী বা ফাল্গুনী নক্ষত্রের নামে হয়েছে ফাল্গুন এবং চিত্রা নক্ষত্রের নামে বাংলা চৈত্র মাসের নামকরণ হয়েছে। বঙ্গাব্দের এই বারোমাসের নামকরণগুলো গৃহীত হয়েছে জ্যোতির্বিজ্ঞান বিষয়ক প্রাচীন গ্রন্থ ‘সূর্যসিদ্ধান্ত’ থেকে।
তবে কবে, কখন, কিভাবে পূর্ণাঙ্গ বারোমাস ও সপ্তাহের দিনগুলোর নাম আমাদের সমাজ ও জাতীয় জীবনে স্থিতি লাভ করেছে তা এখনও গবেষণার বিষয়।