আমাদের শরীয়তপুর প্রমত্তা পদ্মা, মেঘনা ও বিগত যৌবনা আড়িয়াল খা বেষ্টিত একটি জেলা । এ জেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত স্বনাম ধন্যা কীর্তিনাশা । নদীগুলোর শাখা প্রশাখা জেলার শিরায় উপশিরায় প্রবাহমান। ফলে শরীয়তপুরের জনসমাজে নদীর প্রভাব খুবই ব্যাপক। এখানে আঁকা বাঁকা নদী দিগন্ত জোড়া মাঠ, শস্য শ্যামল চত্বর, পালতোলা নৌকা, শতপাখির আনাগোনা কবি মানস বটেই, সাধারণ মানুষের মনকে আন্দোলিত করে। শরীয়তপুর জেলার বেশ কিছু পল্লী- যেমন দে ভোগ, ছয়গাঁও, ধানুকা, ধানকাঠি, কনেশ্বর, ভোজেশ্বর, উপাশি, নোগা শিরঙ্গল প্রভৃতি সত্যিকারের সংজ্ঞাতেই পল্লি। এখানে বাশ বনের ঝোপ, বেতবন, হিজলতমাল গ্রাম বাংলার প্রকৃত স্বরুপকেই উপস্থাপন করে। দোয়েল, কোয়েল, টিয়া, ময়না, ঘুঘু প্রভৃতি পাখির কলতান গ্রাম জীবনকে সর্বদা সজীব রাখে। প্রকৃতির নিরবতা ভেঙ্গে হয়তো কাক ডাকা ভোরে কোন পাখি শিষ দিয়ে উঠে। সন্ধায় ঘরে ফেরার সময় বসন্তে ঝিঝির ছন্দময় ডাক মনকে দোলায়িত করে।
পালতোলা নৌকায় হাওয়া লাগার ফলে আঁকা বাকাঁ খালে পথে কাশ ফুলের সমারোহে সকল হৃদয়কেই
করে স্পন্দিত। কলসি কাখে উচ্ছ্বল যৌবনা গায়ের বধুর প্রত্যূষে গোসল শেষে লাজো চোখে ঘরে
ফেরা নদী তীরের প্রাত্যহিক দৃশ্য। এসকল দৃশ্য কবি মনে বা সাহিত্যিকের কলমে প্রতিবিম্বিত
হয় মুক্তো ধারার মতো। ছন্দে ছন্দে দোলায়িত হয়ে কবি রচনা করেন কবিতা, শিল্পী সাধেন গান,
তুলির আচরে আকেন ছবি আর সাহিত্যিক সৃষ্টি করেন অনুপম সাহিত্য যা মানব সভ্যতার ভান্ডারে
যোগ হয় এক অবিনাশি অবদান হিসেবে।
এ জেলার প্রকৃতির সংগে পার্শ্ববর্তী জেলা বরিশালের প্রকৃতির অনেক মিল। তাই জীবনানন্দ
দাসের কবিতায় বিবৃত প্রকৃতি যেন আমার দেশের প্রকৃতিকেই তুলে ধরে। তিনি যেভাবে বাংলার
মুখকে দেখেছেন আমরাও সেভাবে বাংলার মুখকে দেখতে
পাই। তফাৎটা শুধু এই যে তিনি খু্বই উচু দরের কবি। আর আমরা সাধারণ মানুষ।
বিখ্যাত উপন্যাস ‘পথের পাচালী’র লেখক বিভুতিভুষণ বন্দোপাধ্যায় এর শ্বশুড় বাড়ি
ছিল ছয়গাঁও গ্রামে বলে কথা শুনা গেছে। সে সুবাদে তিনি বেশ কিছুদিন আমাদের এ জেলায় বেড়িয়ে
গেছেন। বোধকরি তার সাহিত্যের উপজীব্য বাশবন, কাশফূল আর ঘাসফড়িং এ সবুজ বনানী শরীয়তপুরের
গ্রাম হতেই আহরিত। পল্লি কবি জসিম উদ্দীনের রুপাই, সাজু আসমানি এবং পল্লির অন্যান্য
বিবরণ যেন আমাদের জনপদের রাখাল, কৃষক কণ্যার পল্লির বিবরণ তুলে ধরে।
আমাদের জেলার গর্ব আর্ন্তজাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সুসাহিত্যিক আবু ইসহাকের ‘সূর্যদীঘল
বাড়ি’ উপন্যাসের চরিত্র প্রকৃতি শরীয়তপুরের গ্রামের মানুষের চরিত্র প্রকৃতির সুষ্পষ্ট
প্রতিকৃতি। তার উপন্যাসের বাকরীতি ও চরিত্রের ভাষা শরীয়তপুরের শত শত দরিদ্র নারীর কথা
কয়। তার উপন্যাসের বাকরীতি ও চরিত্রের ভাষা
শরীয়তপুরের গ্রামের মানুষেরই ভাষা। এ ভাষাকে তিনি সার্থকভাবে তুলে ধরতে পেরেছেন তার
লেখনীতে । এর সূর্য দীঘল বাড়ি ছায়াছবি সমগ্র বাংলাদেশের মানুষের ও প্রকৃতির সফল প্রতিনিধিত্ব
করে নন্দিত পুরস্কৃত হয়েছে বিশ্বময়।
আবু ইসহাকের অপর উপন্যাস পদ্মার পলিদ্বীপ শরীয়তপুরের পদ্মা তীরের মানুষের চরিত্রকে
সফল ভাবে তুলে ধরেছে। তার আরেক উপন্যাস ‘জাল’ সুন্দর সৃষ্টি। আবু ইসহাকের ছোট গল্পের
সংকলন হারেম ও মহাপতঙ্গ বাংলা সাহিত্যে অমূল্য অবদান।
সংস্কৃত কবি জয়ন্তী দেবী, আনন্দময়ীসহ বেশ কয়েকজন সংস্কৃত কবি সংস্কৃত সাহিত্যকে
সমুজ্জ্বল করেছেন। তারা শরীয়তপুর সন্তান। স্বর্ণ কমল ভট্টাচার্য কোলকাতায় সাংবাদিকতা
করতেন। তিনি ‘ফরয়ার্ড’, ‘আনন্দ বাজার’ যুগান্তর এবং আরো কয়েকটি পত্রিকার সংগে যুক্ত
ছিলেন। তিনি অনেকগুলো উপন্যাস ও ছোটগল্প রচনা করেন। উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হলো তীর তরঙ্গ
তথাটি অন্ত্যষ্টি প্রভৃতি।
কবি গোবিন্দ রায় এর কবিতা বাংলা সাহিত্যের অমুল্য সম্পদ। নড়িয়ার কানুর গায় জন্মগ্রহণকারী
এ কবি আমাদের কৃতি সন্তান। শরীয়তপুর সদর থানায় জন্মগ্রহণকারী আব্দুল ওয়াজেদ আরবি, ফার্সি,
উর্দু সাহিত্যে বিশেষ দক্ষতা অজর্ন করেছিলেন। উর্দু ভাষায় তার রচিত গ্রন্থ পেশোয়ারি
বেদার বখত ও পরীমহলকা উল্লেখযোগ্য।
ইদিলপুরে জন্মগ্রহণকারী দেবদাস গুপ্তর সাহিত্য কর্ম উল্লেখযোগ্য। কিশোর বয়স হতেই
তিনি সাহিত্য কর্মে মনোনিবেশ করেন। তার প্রকাশিত গ্রন্ত আকাশ পৃথিবী আকাশের কথা আমাদের
পৃথিবী প্রেমের কথা বাংলা সাহিত্যে বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে আছে।
চরআত্রায় জন্মগ্রহণকারী লায়লা রশিদের সাহিত্য ও বাংলাদেশে জনপ্রিয়তা লাভ করেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ল্যাবরেটরী স্কুল ও কলেজে অধ্যাপনারত লায়লা রশিদের প্রকাশিত গ্রন্থ
আদিম স্বপ্নে বসতি, আমার অস্তিত্বে তুমি বর্ণে বর্ণে বর্ণমালা সোনার খাচায় বনের পাখী
উল্লেখযোগ্য।
শরীয়তপুর সদর থানার বালূচর গ্রামে জন্মগ্রহণকারী কথা শিল্পী সাবিত্রি রায় এর সাহিত্য
কর্ম অত্যান্ত জীবনমুখি বৃহত্তর জীবনের কথায় ভরপুর। তার গ্রন্থ সমূহ হলো সুজন, ত্রিস্রোতা,
পাকা ধানের গা ন, মেঘনা পদ্মা অথবা সমুদ্রের ঢেউ, মালশ্রী, স্বরলিপি, নতুন কিছু নয়,
হলদে মোয় নীল চিঠির ঝাপি ইত্যাদি।
ইতিহাসে উল্লেখ আছে যে একবার সমগ্র বিক্রমপুরের সাহিত্য সম্মেলন ইদিলপুরে অনুষ্ঠিত
হয়েছিল।
পল্লিকবি জসিম উদ্দীনের জীবন ও সাহিত্য কর্মের উপর গবেষণা করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
হতে পিএইচডি ডিগ্রি প্রাপ্ত নড়িয়া থানার দুলুখন্ড গ্রামের শিক্ষাবিদ, গবেষক সাহিত্যিক
ড. সুনীল মুখোপাধ্যায় এর সাহিত্য কর্ম বাংলা সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। ১৯৮১ সালে বাংলা
একাডেমী পুরষ্কার প্রাপ্ত ড. মুখোপাধ্যায়য়ের প্রকাশিত গ্রন্থাবলী হলো জসিমউদ্দিন,
কবি ফররুখ আহমদ মোজাম্মেল হক , সাহিত্য সমীক্ষা জসিমউদ্দিন কবি ফররুখ কবি মানুষ ও কাব্য
সাধনা। গবেষণা ধর্মী বিজ্ঞান ভিত্তিক পুস্তক রচনা করেছেন প্রখ্যাত বিজ্ঞানী গোপাল চন্দ্র
ভট্টাচার্য ও সাধনা ঔষধালয়ের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ যোগেশচন্দ্র ঘোষ। ইহা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ
করেছে। হারবাল গবেষক ডাঃ আলমগীর মতির কতিপয় পুস্তক চিকিৎসা শাস্ত্রে বিরাট অবদান।
স্বাধীনতা সংগ্রামী, এককালীন পশ্চিম বঙ্গ সরকারের শ্রমমন্ত্রী নড়িয়ার সন্তান সুরেশচন্দ্র
বন্দোপাধ্যায় এর সাহিত্য কর্ম উল্লেখযোগ্য । তার রচিত গ্রন্থ জীব প্রবাহ, বুদ্ধচরিত,
শ্রী গৌরাঙ্গ, পৃথিবীর ইতিহাস, মুক্তির পথ, মুক্তি বীণা., অমর মিলন, পথের সন্ধানে পোস্ট
ওয়ার ইউরোপ প্রভৃতি। সুসাহিত্যিক অমলেন্দু দে (ভোজেশ্বর) সাহিত্য কর্মো পশ্চিমবঙ্গে
বিশেষ সমাদৃত । তার অনেক সাহিত্য কর্মের মধ্যে স্বাধীনতা সংগ্রামী পুলিন বিহারী দাসের
জীবন সংক্রান্ত গবেষণা ধর্মী পুস্তক তাকে চিরকাল স্মরণ রাখবে। তার অনুজ অধ্যাপক কবি
কাজলেন্দু দের কবিতার বই নিশ্চিন্দিপুরের গল্প একটি প্রচ্ছন্ন কবিতা মালার সংকলন।
রাজনৈতিক কারণে কারাবরণ কালে কর্ণেল (অবঃ)
শোকত আলী লিখেছেন কারাগারের ডাইরী একটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ।
বিপ্লবী সিরাজ শিকদার গণযুদ্ধের উপর কবিতা লিখেছেন যা সমাজতন্ত্রীদের জন্য বিশেষ
প্রেরনা। তার বোন শামিম শিকদার ভ্রাতা সিরাজ শিকদারের উপর কতিপয় কবিতা রচনা করে কমরেড
সিরাজ সুভ্রাতা নামে প্রকাশ করেছেন।
সমাজকর্মী, কবি ও সাহিত্যিক রথীন্দ্র কান্ত ঘটক চৌধুরীর সাহিত্য কর্ম নিঃসন্দেহে
প্রশংসা যোগ্য । তার প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে কয়েকজন লোক কবি ও প্রসঙ্গত, সুকান্তর
হস্তাক্ষরে কবিতার পান্ডুলিপি, রবীন্দ্র তরুমূলে, ঝরাপাতা, পূর্বাপর উল্লেখযোগ্য। তার
জীবনীর উপর কায়েশ আহমদ লিখিত একটি পুস্তক ১৯৯০ সালে বাংলা একাডেমী কর্তৃক প্রকাশিত
হয়। রথীন্দ্রকান্তের পিতা সূর্যকান্ত ঘটক চৌধুরীরর সাহিত্য কর্ম উল্লেখযোগ্য ।
এ পুস্তকের লেখক আবদুর রব শিকদার বেশ
কটি গ্রন্থ রচনা করেছেন। বাংলা সাহিত্যের দীর্ঘতম প্রেমপত্র ইতি তোমারই নাঈম তার অনবদ্য
অবদান। পুস্তকখানি সুধী মহলে সমাদৃত হয়েছে। এছাড়া তিনি শমরিতাঃ তুমি এসো নামক একখানি
কাব্য গ্রন্থ রচনা করেছেন। তার আন্তজীবনী মূলক
গ্রন্থ জীবন এক বহতা নদী এক বড় মাপের কাজ। এছাড়া তিনি বহু ছোট গল্প কবিতা রচনা করেছেনে। যা বিভিন্ন সংকলনে প্রকাশিত
হয়েছে। এপেক্স ক্লাবের উপরো তার এপেক্স দিশারি নাম একতি তথ্য মূলক পুস্তক রয়েছে যা
এদেশের এপেক্স আন্দোলনকে গতিশীল করতে সহায়তা করছে।
সরকারের যুগ্ম সচিব মোঃ খুরশীদ আলম একজন বিশিষ্ট কথা সাহিত্যিক । তার ১২ টি উপন্যাস
৬টি গল্প সংকলন ও ১টি প্রবন্ধের বই প্রকাশিত হয়েছে। ডাঃ মোসলেম উদ্দিন খান এর রয়েছে
১২টি উপন্যাস যা বাংলা সাহিত্যকে বিকশিত করেছে। তার উপন্যাসগুলো হলো মহারাজ, সুর্যোদয়ের
সীমানা, নোঙ্গর হারা, বংশধর, অনন্ত দিগন্ত, নীল সাগরের দেশ, সেলামী।
প্রাপ্ত তথ্যের উপর ভিত্তি করে এ নিবন্ধ রচিত। এর বাইরেো বহু খ্যাতনামা কবি সাহিত্যিক
এখানে জন্ম গ্রহণ করেচেন যাদের কৃতকর্মে তারা একদিন প্রস্ফুটিত হয়ে উঠবেন।
সাহিত্য চর্চায় শরীয়তপুর পিছিয়ে নেই। রথীন্দ্রকান্ত ঘটক চৌধুরীর স্মৃতি রক্ষার্থে
এখানে রথীন্দ্র সাহিত্য পরিষদ নামে একটি সাহিত্য চর্চা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত আছে। এছাড়া
এ জেলায় বিভিন্ন স্কুল কলেজে প্রচুর সাহিত্য ম্যাগাজিন প্রকাশিত হচ্ছে যা উল্লেখ করে
শেষ করা যাবেনা। উপরোক্ত প্রেক্ষিতে দেখা যায় শরীয়তপুর সাহিত্য কর্মে একটি সাধারণ অঞ্চল
নয় বরং পদ্মার পলিদ্বীপের উর্বরা ভূমির ন্যায় সাহিত্য ক্ষেত্রে অত্যান্ত উর্বর।
লেখক পরিচিতি :
আবদুর রব শিকদার
( মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, সাবেক সরকারি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, বিশিষ্ট লেখক, কবি, সংগঠক এবং সমাজনেতা)
লেখক ঠিকানা: লাকার্তা, ভেদরগঞ্জ, শরীয়তপুর ।
জন্ম: ১৬ আগষ্ট ১৯৪৭ শরীয়তপুর জেলার ভেদরগঞ্জ উপজেলার ছয়গাঁও ইউনিয়নস্থ লাকার্তা গ্রামে। শরীয়তপুর জেলার ইতিহাস- “শরীয়তপুর অতীত ও বর্তমান” এর লেখক। বাংলা সাহিত্যের দীর্ঘতম প্রেমপত্র ইতি তোমারই নাঈম আবদুর রব শিকদার এর অনবদ্য অবদান। ২০২১ সালে ঢাকাস্থ শরীয়তপুর লেখক পরিষদের ব্যবস্থাপনায় ‘অতুলপ্রসাদ সেন-আবু ইসহাক সাহিত্য পুরস্কার’ লাভ করেন আঞ্চলিক ইতিহাস রচনায়। বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী জনাব শিকদার দাদা নাতির মধুর সম্পর্ককে অধিকতর নিবিড় করার লক্ষ্যে গ্র্যান্ড পেরেন্টস ডে সেলিব্রেশন কাউন্সিল বা জিডিসিসি বাংলাদেশ নামক সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান।